খোদ মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কার্যত অচল হয়ে পড়ে থাকা সরকারি হাসপাতালগুলি ফেলে না-রেখে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পরিষেবা চালানো হবে সেখানে। প্রথম দফায় এ জন্য তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন বিজয়গড় স্টেট জেনারেল হাসপাতালকে। তার পরে কেটে গিয়েছে ছ’মাসেরও বেশি। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার কোনও চেষ্টা তো হয়ইনি, উল্টে হাসপাতালগুলির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। শুধু বিজয়গড়ই নয়, একই অবস্থা গার্ডেনরিচ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল বা রামরিক হাসপাতালেরও।
বিজয়গড় ও গার্ডেনরিচ হাসপাতালে দস্তুরমতো চিকিৎসকেরা রয়েছেন, যন্ত্রপাতি এবং অপারেশন থিয়েটারও রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, চিকিৎসকেরা আসেন-যান, কোনও অস্ত্রোপচার করেন না। গত তিন মাস ধরে জটিল অস্ত্রোপচার তো দূর অস্ত্, প্রসূতির সামান্য সিজার-ও সেই সব হাসপাতালে মাসের পর মাস বন্ধ!
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, এই হাসপাতালগুলি চালাতে দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থাকে। রক্ষণাবেক্ষণ, অস্ত্রোপচার, সরঞ্জাম কেনা, কর্মীর ব্যবস্থা সবই করবে ওই সংস্থা। কিন্তু সেটা শুধু মৌখিক ঘোষণার স্তরেই থেকে গিয়েছে। সম্প্রতি গার্ডেনরিচ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল ও বিজয়গড় স্টেট জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের কর্তারা চিঠি লিখেছেন স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছে। তাঁরা অভিযোগ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কাছেও। টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রের কথায়, “বিশ্বাসই করতে পারছি না কলকাতার উপরে এমন অবস্থা দেখতে হতে পারে। হতবাক হয়ে গিয়েছি। ডাক্তারেরা সেখানে যখন খুশি যাচ্ছেন-আসছেন বা আসছেন না, অথচ মাইনে পাচ্ছেন। সামান্য সিজারও হচ্ছে না। স্থানীয় গরিব মানুষকে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। এমন সরকারি হাসপাতাল রেখে লাভ কী?”
টাস্ক ফোর্সের তরফে স্বাস্থ্য দফতরকে এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে যে, হাসপাতালগুলি আলাদা-আলাদা ভাবে কাজ করতে না পারলে এদের একসঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হোক। যেমন, বিজয়গড়ের চিকিৎসকদের কাছাকাছি বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল-এ বদলি করে দেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়বে। সেখানে সব রকম পরিষেবা দেওয়া হবে। আর বিজয়গড় হাসপাতালে স্বাস্থ্য দফতরের কোনও সহায়ক পরিষেবা বা সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বে কোনও প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জনবাবু বলেন, “অভিযোগ শুনেছি। ওই দুই হাসপাতালে একটা সমস্যা হচ্ছে। কোথাও বলা হচ্ছে ওটি-তে লাইট নেই, কোথাও বলছে চিকিৎসকের অভাব। এ ভাবে চলতে পারে না। এটা দুঃখজনক। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছি।”
অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজয়গড় হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানান, সেখানে মাত্র এক জন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি আবার ‘ফ্রোজেন শোল্ডার’ রোগে ভুগছেন! ফলে কোনও সিজার বা স্ত্রী-রোগ সংক্রান্ত অস্ত্রোপচার করতে পারেন না। আগে অন্য এক মেডিক্যাল অফিসার টুকটাক সিজার করতেন। কিন্তু অভিযোগ, তিনি সরকারকে মিথ্যা বলে জেলার এক হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় স্ত্রী-রোগে ডিপ্লোমা করেছিলেন। ফলে শাস্তি স্বরূপ সরকার তাঁর অস্ত্রোপচার করা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে ওই চিকিৎসক যে ক’টি সিজার করতেন, তা-ও এখন বন্ধ। হাসপাতালের এক বড় কর্তার কথায়, “হাসপাতালে সার্জন মাত্র এক জন। মেডিসিন, অ্যানাস্থেশিয়া, চোখ, কান, হাড়ের কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। মেডিক্যাল অফিসার মাত্র চার জন। এ ভাবে কি কোনও পরিষেবা চলতে পারে? নাকি অস্ত্রোপচার হতে পারে? চিকিৎসকেরা আউটডোর চালাবেন, না অস্ত্রোপচার করবেন?”
গার্ডেনরিচ হাসপাতালে অবশ্য ১৪ জন চিকিৎসক। এর মধ্যে দু’জন অ্যানাস্থেটিস্ট, দু’জন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ। টাস্ক ফোর্সের কর্তারা সরেজমিন ঘুরে অভিযোগ করেছেন, ১৪ জনের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই মেরেকেটে এক দিন হাসপাতালে আসেন! বাকি দিন কে বা কারা যেন খাতায় সই করে যায়। পুরোদস্তুর অপারেশন থিয়েটার থাকা সত্ত্বেও সেখানে প্রয়োজনীয় আলোটুকু এখনও লাগানো যায়নি। ফলে অস্ত্রোপচার হয় না। প্রসূতিরা চলে এলে পত্রপাঠ অন্যত্র ‘রেফার’ করা হয়।
শুধু এই দুই হাসপাতালই নয়, ভবানীপুরে রামরিক হাসপাতাল নিয়েও উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য দফতর। ৩১ জুন হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ করা হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্যান্য হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু ওই জায়গায় ঠিক কী করা হবে, সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এসএসকেএম-এর বর্ধিত ক্যাম্পাস হিসেবে সেখানে অর্থোপেডিক দফতর সরিয়ে আনা হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকে বলছেন, এমনিই চিকিৎসকের অভাব, তাতে বর্ধিত ক্যাম্পাস হলে বাড়তি অসুবিধা। তা ছাড়া, ওখানে কিছু করার আগে আবার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে হাসপাতালের এক ভবনে জবরদখল করে থাকা তিনটি পরিবারকে। তার চেয়ে ওখানে সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রক্রিয়ায় এক্স-রে, প্যাথলজি ও ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান হোক। কিন্তু চার মাস পরে এখনও কোনও সিদ্ধান্তই হয়নি। |