দুর্ঘটনায় মৃত্যু, আইনের ফাঁদে তাই ব্যর্থ চক্ষুদান
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকে নীতিগত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল ছোট্ট একটি চিঠি।
দুর্ঘটনায় মৃতের চোখ ময়নাতদন্তের আগে কি দান করা সম্ভব? কারণ মৃত্যুর ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া তুলতে হয়। আর ময়না তদন্ত করতেই দশ থেকে বারো ঘণ্টা, কখনও বা গোটা একটা দিনই কেটে যায়। তা হলে?
সম্প্রতি একটি ঘটনা এই প্রসঙ্গ উস্কে দিয়েছে। ট্রেনের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন নদিয়ার পায়রাডাঙ্গার বাসিন্দা স্বপনকুমার দাস। প্রথমে রানাঘাট স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, সেখান থেকে কল্যাণী হাসপাতাল হয়ে তাঁকে ভর্তি করা হয় এনআরএস-এ। এত চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি তাঁকে। দিন কুড়ি পর মৃত্যু হয়। বছর পঞ্চাশের এই অখ্যাত মানুষটির মৃত্যুই রাজ্য প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
স্বপনবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর দুই ভাই তরুণ ও তপন দাস দাদার চক্ষুদান করতে চেয়ে এনআরএস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন জানান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, ময়নাতদন্তের আগে দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তির চোখ নেওয়া সম্ভব নয়। এর পর দুই ভাই এন্টালি থানা (এই থানার অধীন এনআরএস হাসপাতাল)-র দ্বারস্থ হন।
পুলিশ তাঁদের জানায়, চাকদহ ও রানাঘাট জিআরপি থানা থেকে (দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ওই দুই থানার অফিসারেরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন) লিখিত নির্দেশ আনতে পারলে তবেই ময়নাতদন্তের আগে মৃতের চোখ নেওয়া যেতে পারে। শেষ চেষ্টা হিসাবে তরুণ ও তপনবাবু ওই দুই জিআরপি থানার সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। সব শুনে তারা রায় দেয়, মৃতদেহের ময়নাতদন্তের জন্য তারা লিখিত নির্দেশ দিচ্ছে। তবে তার আগে কখনই চক্ষুদানের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
৮৩ বছরের বৃদ্ধা মা-সহ পরিবারের সকলেই চেয়েছিলেন, স্বপনের চোখ দিয়ে কেউ এক জন দৃষ্টি ফিরে পাক। হাসপাতাল ও থানা ফিরিয়ে দেওয়ায় সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি তরুণবাবুরা। কারণ, আইন মেনে মৃত্যুর ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে মৃতের কর্নিয়া তুলতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে দশ-বারো ঘণ্টা বা কোনও কোনও সময় গোটা দিনটাই কাবার হয়ে যায়। ফলে কর্নিয়া আর নেওয়ার যোগ্য থাকে না।
সপ্তাহ দুই আগে স্বাস্থ্য দফতরের অধীন চক্ষু বিভাগের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মৃত স্বপনবাবুর দুই ভাই ওই অভিযোগ করে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তা হলে কি দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে তাঁর চোখ দান করা যাবে না’? স্বাস্থ্য দফতরের উত্তর হচ্ছে‘না’।
চক্ষু বিভাগের সহ-স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী ও নীলরতনের চক্ষু বিভাগের চিকিৎসক অনিল ঘাটা ওই ঘটনার কথা শুনেছেন এবং মেনেও নিয়েছেন। সিদ্ধার্থবাবুর কথায়, “আমরা সত্যিই কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। কোনও হাসপাতাল দায়িত্ব নিয়ে এটা করাতে পারে। কিন্তু এমন কোনও আইন আমাদের হাতে নেই।” পুলিশের তরফে ওসি হোমিসাইড অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান, আইন নেই বলে কোনও থানাকে বাধ্য করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য দফতরের খবর, অঙ্গ দান করা নিয়ে দেশে ‘হিউম্যান অর্গ্যান ট্রান্সপ্লান্টেশন অ্যাক্ট’-৯৪ চালু আছে। কিন্তু তাতে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। যদিও অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থান, কর্নাটকের মতো কয়েকটি রাজ্য নিজেদের উদ্যোগে এই সংক্রান্ত আইন করেছে।
এ রাজ্যে আইন নেই, শুধু তাই নয়। নিকট ভবিষ্যতেও এমন কোনও আইন করার ভাবনা-চিন্তা নেই।
স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কথাতেই তা স্পষ্ট “বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। আইন করে চটজলদি এর সমাধান করা যাবে না। ময়নাতদন্তের আগে চোখ তুলে নিলে তদন্তে কোনও প্রভাব পড়বে কি না, তা দেখার। অন্য কয়েকটি রাজ্য কী ভাবে আইন করেছে, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে।”
সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, রাজ্যে প্রতি বছর গড়ে ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ১ শতাংশের থেকেও কম মানুষ চক্ষুদানে সম্মত হন।
অথচ রাজ্যে বছরে প্রায় ৬০ হাজার চোখের প্রয়োজন হয়। ২০১২ সালে পাওয়া গিয়েছে মাত্র ৩২০০টি। চক্ষুদানে দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
রাজ্যে চক্ষুদান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্রজ রায়, মলয় ঘোষাল, ভাস্কর সিংহরা জানান, পুলিশের উপর চাপ দিয়ে বা অনুরোধ করে মাঝেমধ্যে ময়নাতদন্তের আগেই চোখ নেওয়া হয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, “একটা চোখের জন্য যেখানে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে বাড়ির লোকের অনুমতি পেলেও কেন দুর্ঘটনায় মৃতের চোখ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না?” এই নিয়ে স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র দফতরকে বার বার চিঠি দিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে জানান তাঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.