|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র |
ঠাকুর দেখতে যাবি?’ একটা মোলায়েম, প্রশ্রয় দেওয়া গলা। বয়স্ক লোক বলেই মনে হচ্ছে। শব্দটা এসেছে আমার ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে। সাধারণত কেউ এলে বেল বাজায় প্রথমে। এ রকম করে ডাকে না। চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলাম, ঘুম ভেঙে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু উঠিনি। রাতে মনে হল ঢাক বাজছে, আসলে মেঘ ডাকছিল। ভোরবেলা ছিড়িক ছিড়িক কাঠি পড়ল কয়েক বার। বৃষ্টিও হল বোধ হয়। চাদরমোড়া অন্ধকারে আমি নিজেকে লুকিয়ে ফেললেও গুড়গুড় গুমগুম আওয়াজটা বার বার ঢুকে আসছিল আমার শরীরে। আওয়াজগুলো শুনলেই আন্দাজ করতে পারি বাড়ির পাশের পুজোর প্যান্ডেলের অবস্থাটা। এখানে কেউ গলায় ব্যাজ ঝুলিয়ে সম্মানটম্মান দেওয়া যায় কি না, তা পরখ করতে আসে না। বেশ টলটলে, একটু রাগী, একটু অন্যমনস্ক দুর্গাঠাকুর আছে যদিও। কিছুটা অনুতপ্ত সবুজ অসুর, আর যারা ফি বছর আসে, তারাও আছে। বাঁশ দিয়ে বানানো খাঁচাটা ঢাকা পড়েছে অভিশপ্ত দেউলের বেরিয়ে পড়া ইট, অশ্বত্থের ঝুরি আঁকা ছবির চাদরে। সম্ভাব্য দর্শকের দৃষ্টির বাইরে রিফিউজি তেরপল, টিন, এই সব। প্যান্ডেলের মধ্যে একেবারে কেউ নেই তা নয়, লক্ষ্মীর প্যাঁচার পাশে বসে পুরুত ফুল-পাতা সরিয়ে পয়সা বের করছে। নীচে, কাদা বাঁচিয়ে টুকটুক করে এক ময়লা দাদু নাতনিকে কোলে নিয়ে পৌঁছে গেছেন ঠাকুরের পায়ের কাছে। বলছেন, ‘বলো, নমো নমোও।’ নাতনি বলছে, ‘মোমো-মোমো।’ এ সবই আমার ধারণা, কারণ আমি এখনও চাদর থেকে মুখই বের করিনি। কে জানে আজ অষ্টমী, না কি ষষ্ঠী?
‘কে-এ?’ গলাটা ছাড়লাম। মুখটা তেতো হয়ে আছে, কাঁধের ব্যথাটা একটু জানান দিল। রোলকল শুরু হয়ে গেল সারা শরীরে। ব্যথা ইয়েস। যন্ত্রণা আছি। চোখ দপদপ হ্যা।ঁ উঠে বসলাম, মোবাইল ফোনের দিকে হাত বাড়াচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই বাইরে থেকে আওয়াজ এল, ‘খো-ও-ল।’ দরজার কড়াটা নিয়ে খেলা করছে যে এসেছে, অধৈর্য ভাবে খটখট করছে না কিন্তু। বেল-ও বাজাচ্ছে না।
খুব চেনা কেউ, বন্ধু নিশ্চয়ই, অথবা হুজ্জুতবাজ জামাইবাবু। জানে আমার কোনও কিছুতে উৎসাহ নেই, কোথাও যাই না। বন্ধুরা আগে ডাকত। এখন আর বলে না, যাব বলে যাই না বলে। আসলে মদ খেতে অনেক টাকা লাগে। তবে রাস্তায় দেখা হলে খুব সৎ ভাবেই বাড়িতে আসতে বলেটলে।
আমার বন্ধুদের বউরা খুব ভাল। আমার সব ব্যাপারেই সবাই জানে, কিন্তু কেউ আর গালাগালি দেয় না। বইমেলাতে এক বার দেখা হয়ে গেল ভাস্করের সঙ্গে, অনেক দিন পরে। ওর বউ খুব উজ্জ্বল মুখে বলল, ‘আপনার লেখা পড়তাম খুব, অওসাম।’ তার নামটা জানা হয়নি, জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি হচ্ছিল। মুখটা মনে আছে, দুর্গা দুর্গা।
বাথরুম থেকে ঘুরে এলাম। তার পর বন্ধ দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়ালাম। ভাববার চেষ্টা করছিলাম দরজার উলটো দিকে কে থাকতে পারে, গলাটা একেবারে অচেনা। সেটাই মুশকিল। প্রথমেই দরজা খুললে ঝামেলা মিটে যেত। খুলিনি। কিছুটা সময় চলে গেছে। এখন খুললে একটা জবাবদিহি করার ব্যাপার থাকবে। দরজার কাঠে কান ঠেকিয়ে মুখটা মনে করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কুড়কুড় আওয়াজটা হল আর এক বার। যে এসেছে সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কড়াটা নিয়ে আলতো করে খেলছে। কোনও রাগ নেই, অঙ্ক নেই, টেনশন নেই। |
|
ছবি: শুভময় মিত্র। |
‘সকালে বাগবাজারে গিয়েছিলাম, ওহ্ কী ঠাকুর রে! এইয়া চোখ। কিন্তু একটু পরে আমাকে বের করে দিল। একেবারে সামনে চলে গিয়েছিলাম তো, সবাই ছবি তুলছে, তোর মতো ক্যামেরাও আছে। চার দিকে কত মোবাইল রে, কেউ কথা বলছে না, খালি হাত তুলছে। তা আমাকে বের করে দিল, আমি অবশ্য অনেক ক্ষণ ধরে দেখে নিয়েছি। ওই মুখ আমার মনের মধ্যে ঢুকে গেছে।’ দিব্যি বলে যাচ্ছে সকালের অভিজ্ঞতা, শুনছি। ‘হাত তুলে কেউ প্রণাম করছিল না, খালি ছবি তুলছিল। তার পর তো চিৎপুরে গেলাম, ওখানে রাস্তায় কচুরি ভাজছিল। দিল না। তখন আবার শোভাবাজারে গেলাম। ওরা কিন্তু খুব ভাল লোক, তোর চেনা নিশ্চয়ই। এক জন রাজার মতো লোক আমাকে খাবারের প্যাকেট দিল। খেয়ে বাইরে এসে টিপকলে মুখ ধুয়ে নিলাম। খালি পুরনো হলে হয় না। বনেদি হওয়া কি এত সোজা নাকি? ওরা খুব ভাল লোক। ওদের বড় ইতিহাস আছে। কী রে?’
আমার মাথার মধ্যে অনেকগুলো মুখ ঘোরাফেরা করছিল, কিন্তু কোনওটাই স্পষ্ট নয়। আমার চেনা এমন কেউ নেই, যাকে পাবলিক পুজোমণ্ডপ থেকে বের করে দেবে। তুইতোকারি করছে যখন, এবং যে রকম গলার স্বরে, তাতে বদমাইশি করবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, সাতসকালে এ ভাবে এসে ডাকবেই বা কেন? যে এসেছে, সে কোন পাড়ায় থাকে সেটা বুঝতে পারলে সুবিধে হত। বললাম, ‘সাউথের কিছু দেখিসনি?’
না না, ওখানে তো বেশি প্রাইজের ঠাকুর। ও সব তোর সঙ্গে দেখতে হবে। আর্টের ব্যাপারটা তো তুই-ই আমাকে ধরিয়েছিলি। সেই বাদাম সঙ্ঘ আষাঢ়তলায় তুই-ই তো বলেছিলি ভাল মনে যা হয় তা-ই সুন্দর, সেটাই আর্ট। মনে আছে রে, সব মনে আছে। তোর কথা কত বার যে মিলে গেছে, যিনিই দুর্গা, তিনিই বুদ্ধ।’ নাম গুলিয়েছে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, এই সব কথা আমি বলেছিলাম, সেটা মনে পড়ছে। কাকে, সেটা ব্ল্যাংক। ‘তুই বলেছিলি এক বার রিকশা করে পুজো দেখতে বেরোব দুজনে। পার্কিং-এর ঝামেলা নেই। এক বার তুই টানবি, এক বার আমি।’ একটা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পরিষ্কার বুঝতে পারছি। ঘরের মধ্যে আলোটা কমে আসছে, জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম মেঘ করে আসছে। তার মানে আজও পুজো পণ্ড হবে। খারাপ লাগছে, কিছু করার নেই। এটা গরিবদের এক মাত্র আমোদ-আহ্লাদের সময়। ভোরের ট্রেনে আসে শহরে। সারা দিন হেঁটে হেঁটে দেখে সব। ধর্ম বা আর্ট বোঝে কি না-বোঝে জানি না, মুখ দেখে বুঝতে পারি একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলে। অনেক রাতে এক প্লেট নুড্ল্স কিনে সবাই মিলে খায়। অল্প বয়সি মা-টা নিজে না খেয়ে চেষ্টা করে বাচ্চাদের খাইয়ে দিতে। কোনও কমপ্লেন করার ব্যাপার নেই।
‘বলা উচিত নয়, তোকে বলেই বলছি, বৃষ্টি হয়ে আমার খুব সুবিধে হল। ফাঁকা, সব ফাঁকা। কোনও ভিড়ই নেই। যেখানে খুশি চলে যাও। লোক আটকানোর জন্য সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে কী বাঁশ দিয়েছে রে, যাদের জন্যে তারাই তো বাড়িতে ঢুকে বসে আছে, ভয়ে।’ কড়মড় করে শব্দ হল, পাশের বাড়ির বারান্দার টিনের চালে, জল পড়ার আওয়াজ। আবার বৃষ্টি নেমেছে। বাইরে যে দাঁড়িয়ে আছে, সেও ভিজছে নিশ্চয়ই।
‘আরে দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে রে। আগে হলে কত কী লিখে ফেলতাম, তুই তো সব জানিস। হাতে চোট লেগে গেল, ব্যস সব বন্ধ হয়ে গেল। এক হাতে কি কিছু লেখা যায় নাকি? তুই কি এখনও বাঁ হাতে লিখিস?’
কেন যে দরজাটা খুলতে পারছিলাম না, কে জানে। পুজোর সকালে এমন এক জন এল, আমার ভয়টা কীসের? বাদ দিতে দিতে অল্প কয়েকটা মুখের ছবি বন্ধ দরজাটার ওপর ভাসছিল, আমি নিশ্চিত জানি, তার মধ্যেই এক জন হবে। অপরাধীদের সঙ্গে মেশা যায়, কিন্তু খুব গরিব বা পাগল জাতীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলায় বিপদ আছে। এরা পর পর মিথ্যে কথা বলে, শেষে টাকা চায়। দিলে চলে যায়, কিন্তু আবার ফিরে আসে। আমার ধারণা আমি পাগলও নই, গরিবও নই, তাই দরজা খুলতে পারছি না।
গুমগুম, ধড়মড় করে মেঘ আর ঢাক বেজে উঠতেই আমার মাথার মধ্যে আলোর ফ্ল্যাশ হল এক বার। সব ছবি সরে গিয়ে একটা মুখ ঝক করে সামনে এসে গেল। সুনন্দ! নানা রকম খামখেয়ালিপনা আর সময় নষ্ট করে এখন উন্মাদ হয়ে গেছে, নোংরা অবস্থায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, বাড়িতে দাদা-বউদি আছে, এলেই আবার বের করে দেয়। এ ছাড়া নানা কারণে মারধর খাওয়া তো আছেই। একটা চোখ নষ্ট হয়েছে। এসেছিল এক বার, কিছু টাকা দিয়েছিলাম।
মনটা শান্ত হয়ে এল এ বার। নিজের জামা-প্যান্ট-চটিটা এক বার দেখলাম। তার পর নিজের হাতের তালু দুটো। নানা রকম রেখা, হয়তো মানে আছে এর। জানি না। মনে হল ঠাকুরহীন চালচিত্র। কোনও দুর্গাই আসেনি এখানে। তা না আসুক। সারা শহরে তো এখন দুর্গার ছড়াছড়ি। বেশির ভাগ জায়গাতেই তো তারা সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে, দেখার কেউ নেই। চাইলে তারা সবাই আমাদের হতে পারে আজ সকালে। মানুষের ঢল না নামা রাস্তায় আমরা এখন বেরিয়ে পড়ব। দুর্গা, অসুর, মানুষ, অমানুষ ভরা ভেসে যাওয়া পুরো কলকাতা শহরটা ঢুকে পড়েছে একটা বিশাল মেঘের প্যান্ডেলে। এর সবটা এখন আমাদের, আমরাই শুধু দেখব। শুধু বৃষ্টিটা থামানো চলবে না। দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম হাসি খেলে যাচ্ছে আমার চোখে।
ধড়াম করে খুলে দিলাম দরজাটা। |
|
|
|
|
|