আত্মার রক্ষার জন্য
স্বীকারোক্তি-কুঠুরির শিকগুলোর কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে খুবই বিনীত কণ্ঠে সিস্টার ফিলোমেনা বলতে শুরু করলেন: ফাদার, আমি পাপ করেছি কি না বুঝতে পারছি না। আমার বিবেক কখনও বলছে ‘হ্যাঁ’, কখনও বলছে ‘না’। যখন বলছে না, ওটা কোনও পাপকাজ নয়, তাতে আমি বরং বেশি যন্ত্রণা পাচ্ছি।
ফাদার বললেন, পরিষ্কার করে বলো কন্যা। খুঁটিয়ে বলবে। এত অল্পবয়সি মেয়ে তুমি! আঠারো বছর বয়সের বিবেকের ওপর ভরসা করা যায় না। ওটা আমাকে বিচার করতে দাও।
তা হলে শুনুন ফাদার, পুরোটাই সত্যি। সোমবার মাঝরাতে পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সাত নম্বর রুগি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সান্ত্বনা টের পেলেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক বললেন, আর কোনও আশা নেই। রোগীকে খুব বেশি ক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। ভোরের আগেই মৃত্যু ঘটবে।
আধ ঘণ্টা পর পর এক চামচ ওষুধ খাওয়ানো ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। বিছানার পাশের নিজস্ব জায়গাটায় বসে ওই মৃত্যুপথযাত্রী পুরুষটির আত্মার জন্য প্রার্থনা শুরু করলাম।
তখন প্রায় তিনটে বাজে, ক্ষীণ কণ্ঠে খাবি খেতে খেতে রুগি বললেন, ‘সিস্টার ফিলোমেনা, সে এসে গেছে।’ তাঁর কণ্ঠস্বরে যেন মৃত্যুর খটখট শব্দ পেলাম। ‘ভাই, মনে সাহস আনুন’, তাঁর কানে ফিসফিস করে বললাম। ধীরে ধীরে, খুব কষ্ট করে তিনি বলতে লাগলেন: ‘আমি প্রস্তুত। পঁচিশ বছর বয়সে মারা যাওয়াটা খুবই দুঃখের, কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। সেটাই ভাল। আমি একা, গরিব। ভেবেছিলাম, আমি এক জন কবি, কিন্তু কিস্যু না। ভেবেছিলাম, আমি ভালবাসায় আবদ্ধ, কিন্তু কেউ ভালবাসেনি আমায়। আপনি এ সময় পাশে না থাকলে আমি মরুভূমিতে পরিত্যক্ত মানুষের মতো মরতাম।’
তিনি চুপ করলেন, আমি আবার বললাম: ‘ভাই, সাহস রাখুন, ঈশ্বর আপনার সঙ্গে আছেন।’ কয়েক মুহূর্ত পর লক্ষ করলাম তাঁর গভীর নীল চোখ দুটি অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিস্টার ফিলোমেনা, আমাকে একটু অনুগ্রহ করবেন?’
‘যতটুকু পারব, করব, ভাই।’
তিনি বললেন: ‘আপনি কি চান, আমি শান্তিতে মরি, যে ঈশ্বর আমাকে বানিয়েছেন, তাঁর আশীর্বাদ পাই মৃত্যুর সময়?’
বললাম, ‘প্রত্যেক ন্যায়নিষ্ঠ খ্রিস্টানের সে ভাবেই মরা উচিত।’
রুগিটি নম্র শান্ত কণ্ঠে বললেন: ‘তা হলে সাহায্য করুন।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ভাবে?’
‘যে জীবন ছেড়ে যাচ্ছি, তার চৌকাঠটুকু কোনও তিক্ততা ছাড়াই পার হতে সাহায্য করুন আমায়। পরবর্তী জীবনে যেন একটি করুণার স্মৃতি বয়ে নিয়ে যেতে পারি। সিস্টার ফিলোমেনা, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে একটু করুণা করুন। আমাকে একটা চুমু খান।’
‘চুমু!’ এই অবধি শুনে পাদরিমশাই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।
হ্যাঁ, ফাদার। আমি আবার বললাম, ‘ভরসা রাখুন, প্রস্তুত হোন ঈশ্বরের চুম্বনের জন্য।’ কিন্তু দুর্বল শ্বাস নিতে নিতে তিনি অনুনয় করতে থাকলেন: ‘এই অনুগ্রহটুকু আপনি করুন। আপনি যে আমার পরিত্রাতা হবেন, তা কি বুঝছেন না? আপনি কি সারা জীবন অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকতে চাইছেন? আমার আত্মার বিনাশ চাইছেন আপনি? আমার নরকভোগ ও সর্বনাশের কারণ হয়ে থাকতে চাইছেন?’
ফাদার বললেন, আর তুমি, তুমি কী করলে?
ফাদার, আমি খুব ভয় পেলাম। ভেবে দেখলাম, তিক্ততা নিয়ে মারা গেলে লোকটি বোধ হয় অনন্ত নরকভোগ করবেন। আমারও সেটাই হবে, যদি এর জন্য আমি দায়ী হই। ভাবছিলাম ভোরের আগেই তো সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। সেই শান্ত ঘরে তাঁর কষ্ট করে শ্বাস নেওয়ার শব্দ টের পাচ্ছিলাম। আলোগুলো নিস্তেজ। সেই নিষ্প্রভ আলোয় সাদা বিছানাগুলি সমাধিক্ষেত্রের মতো লাগছিল। প্রচণ্ড দুঃখ হল আমার। ঝুঁকে পড়ে তাঁকে চুমু খেলাম। আবছা শুনতে পেলাম, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।’
‘কোথায় চুমু খেলে?’ ফাদার শান্ত স্বর দিয়ে হতভম্ব ভাব ঢাকার চেষ্টা করছিলেন।
ফাদার, তখনও চার দিক অন্ধকার, তবে মনে হয়, ঠোঁটেই চুমুটা খেয়েছিলাম।
‘উউফ! হঠকারিতা! বুঝতে পারছি, ভাল উদ্দেশ্যেই এটা করেছ। খ্রিস্টীয় পবিত্রতার আবেগে ভেসে গিয়েছিলে। কিন্তু এখানে ভুল ভাবে তার প্রয়োগ করেছ, আমি তো বলব, বিপজ্জনক ভাবেও। ঠোঁটের বদলে ভুরুটুরুতে চুমু খেলে ভাল হত। আত্মাকে বাঁচানোর জন্য সেটা যথেষ্ট। যাক, তুমি তো মৃতপ্রায় মানুষকে চুমু খেয়েছিলে। তিনি যখন মারা গেছেন এবং যথাযথ ভাবে সমাধিস্থ হয়েছেন, শান্তিতে থাকুন। আমরা আর এ নিয়ে ভাবব না।’
কিন্তু ফাদার, ব্যাপারটা সে রকম নয়। তিনি বেঁচে আছেন।
‘বেঁচে আছেন!’
হ্যা।ঁ ভোর পর্যন্ত তিনি মরার মতো অবস্থাতেই ছিলেন। সূর্যের প্রথম কিরণ যেন উপশম বয়ে আনল। ডাক্তারবাবু ওয়ার্ডে ঢুকে অসুস্থ লোকটির মুখে মৃদু হাসি দেখে নিজের বিস্ময় লুকোতে পারেননি। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন, একটা ইঞ্জেকশনও দিলেন, তার পর মৃদু স্বরে বললেন, ‘আশ্চর্য! মনে হয় আমরা এই রোগটাকে এ বার বশে আনতে পারব।’
‘কিন্তু ব্যাপারটা তো সর্বনেশে হয়ে গেল!’ তীব্র হতাশায় ফাদার চেঁচিয়ে উঠলেন।
কী বলছেন ফাদার!
‘এটা সিরিয়াস ব্যাপার, মেয়ে। তুমি যদি কোনও জ্যান্ত মানুষকে ঠোঁটে চুমু খাও, আর সে যদি বেঁচে থাকে, সে ক্ষেত্রে কী করা উচিত আমি জানি না। মৃত্যু দোরগোড়ায় থাকলে আলাদা কথা। প্রভুর দৃষ্টিতে তখন সব কিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু সে যদি বেঁচে থাকে, তা হলে দৈব-অনুকম্পা তো হকচকিয়ে যাবে।’ একটু থেমে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কন্যা, বলো তো, এই ডাক্তারটি ডাক্তার হিসেবে কেমন?’
সেরাদের মধ্যে এক জন।
‘আর, রোগীটি আজ কেমন আছে!’
বেশ ভাল।
‘ব্যস, তুমি শেষ!’
হে ভগবান!
‘এখনও ভগবানের নাম উচ্চারণ করছ, অ্যাঁ?’
আমি সত্যিই খুব পাপী, ফাদার?
‘ওই পোশাক পরার যোগ্যই নও!’
কিন্তু সিস্টার ফিলোমেনা যখন খুব ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, পাদরিমশাই একটু নরম গলায় বললেন, ‘আমি এখনও আমার পথটা পরিষ্কার দেখছি না। তুমি একটু আগে বলছিলে, তোমার বিবেক যখন বলছে, তুমি কোনও পাপ করোনি, তাতে তুমি বেশি কষ্ট পাচ্ছ। এ রকম একটা স্ববিরোধ কী করে সম্ভব?’
জানি না, ফাদার। যেটা অনুভব করছি, অবিকল সেটাই আপনাকে বলেছি।
‘তুমি যা করেছ, তার জন্য কি অনুতাপ হচ্ছে তোমার?’
এটা পাপ হলে অনুতাপ তো হওয়া উচিত।
‘কিন্তু ভেবো না যে এখনই তোমাকে পাপক্ষালনের সুযোগ দিলাম। কয়েক দিন অপেক্ষা করব আমরা। ছোকরাটির অসুস্থতা কোন দিকে যাচ্ছে দেখে সিদ্ধান্ত নেব। এখন যাও। তবে, শুতে যাওয়ার আগে একটু লজ্জিত হোয়ো, বুঝেছ?’
আমি সব সময় লজ্জিত, ফাদার।
‘হলেই ভাল।’
কয়েক দিন পর সিস্টার ফিলোমেনা আবার এলেন ফাদারের কাছে।
‘সাত নম্বর কেমন আছে?’
মনে তো হচ্ছে বেশ উন্নতি হয়েছে।
‘ডাক্তাররা কী বলছেন?’
বলছেন, রোগী সেরে উঠবেন।
‘তোমার কোনও আশাই নেই, বাছা!’
সে কথা আমি তাঁকে বলেছি।
‘কী বলেছ তাঁকে?’
বলেছি, তাঁর জন্য আমি শেষ হয়ে গেলাম। যদি জানতাম তিনি বেঁচে উঠবেন, তা হলে তাঁকে চুমু খেতাম না।
‘আর, ওই সুস্থসবল কবি কী জবাব দিলেন?’
বললেন, তিনি আমার সর্বনাশ কিছুতেই চান না, এবং তাঁর দিক থেকে তিনি আমার আত্মাকে অবশ্যই বাঁচাবেন।
‘সেটা তো তিনি মরে গিয়েও করতে পারতেন!’
হ্যাঁ ফাদার, সে জন্যই তো তিনি শপথ করে বলেছেন যে, যে দিন ডাক্তাররা বলবেন তিনি পুরোপুরি সুস্থ, তিনি আমার জন্যই আত্মহত্যা করবেন।
এ তো নতুন ফ্যাসাদ! পাদরিমশাই কিছু ক্ষণ ভাবলেন, তার পর হাল ছেড়ে বললেন: ‘সব মিলিয়ে, তোমাকে অব্যাহতি দেওয়াই ভাল। এই গোছের একটা লোক যদি ফের মরতে শুরু করে, আমাদেরও কিন্তু একেবারে গোড়া থেকে আবার শুরু করতে হবে।’

(সংক্ষেপিত)
অনুবাদ উজ্জ্বল সিংহ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.