সন্ধে ৭টা, নজরদারিকে তুড়ি মেরে শুরু হল শব্দের তাণ্ডব
লালবাজার কন্ট্রোল রুমের অফিসার তাজ্জব। শনিবার তখন সন্ধে সাড়ে ৬টা। “অন্যান্য বার কালীপুজোর সন্ধ্যায় এই সময়ের মধ্যে শব্দবাজি নিয়ে অন্তত চল্লিশটা অভিযোগ এসে যায়। অথচ এ বার কসবার মন্দিরপাড়া, যোগেন্দ্র গার্ডেন ও টেগোর পার্ক, গোলপার্কের কাছে কেয়াতলা রোড আর উত্তরে বাগবাজার ছাড়া শব্দবাজির অভিযোগ এখনও পর্যন্ত পাইনি,” বললেন ওই অফিসার। কিন্তু তাঁর সিনিয়র ইন্সপেক্টর সন্দিহান, “এত আগে নিশ্চিন্ত হয়ে লাভ নেই। একটু দাঁড়ান। শহর জুড়ে শব্দবাজি ফাটা শুরু হল বলে!” আর হলও ঠিক তা-ই। ঘড়ির কাঁটা সন্ধে সাতটা ছুঁতে না ছুঁতেই শব্দবাজির প্রবল প্রতাপ শুরু হল শহর জুড়ে ও তার আশপাশে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যে ২৬টি দল শনিবার বিকেল ৫টা থেকে শহরে ঘুরছিল, তার মধ্যে একটি দলকে পাওয়া গেল তারাতলার কাছে। ওই জায়গায় পর্ষদের কর্মীরা একটু জল খেতে নেমেছিলেন। সন্ধে সওয়া সাতটা। আর তখনই এমন মুহুর্মুহু শব্দবাজি ফাটতে শুরু করল যেন স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ব্রাশ ফায়ারিং। এক পর্ষদকর্মীর কথায়, “যারা ওই শব্দবাজি ফাটাল, তারা নিজেদের অজান্তেই যেন আমাদের ব্যঙ্গ করল।”
প্রায় একই সময়ে পর্ষদের আর একটি দলকে সদর দফতর ‘পরিবেশ ভবন’ থেকে বার্তা পেয়ে ছুটতে হল লেক টাউনের একটি আবাসনে। সেখানে সেই সময়ে চকোলেট বোমা ও শেল ফাটানো হচ্ছে। ওই দলটিকেই কিছু ক্ষণের মধ্যে ফের ছুটতে হল দমদমে। রাত যত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে শব্দবাজির দৌরাত্ম্য। রাত বারোটা নাগাদ লালবাজার সূত্রে জানানো হল, তাদের কাছে অভিযোগের সংখ্যা ৭০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে শব্দবাজি ফাটানো এবং অভব্য আচরণের জন্য সব মিলিয়ে ২২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শহর কলকাতার থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকায় শব্দবাজির তাণ্ডব আরও বেশি ছিল বলে অভিযোগ। গভীর রাত পর্যন্ত লেকটাউনের বিভিন্ন বহুতল থেকে পুলিশ ২১ জনকে গ্রেফতার করেছে। আটক করা হয় প্রায় ৫০ কেজি শব্দবাজি।
রাত আটটার পর থেকে শব্দবাজির তাণ্ডব শুরু হয় দক্ষিণের ম্যাডক্স স্কোয়ার থেকে আলিপুর, নিউ আলিপুর থেকে যাদবপুর, বাঘাযতীন। বেহালা-ঠাকুরপুকুর, আমতলা, বারুইপুরও বাদ যায়নি। একই হাল পূর্ব যাদবপুরে ই এম বাইপাসের ‘উপহার’ ও ‘হাইল্যান্ড পার্ক’ আবাসন, গড়ফা এলাকার অন্তর্গত ‘অভিষিক্তা’-য়। এম আর বাঙ্গুর হাসপাতাল চত্বরের ভিতরে বিরামহীন ভাবে শব্দবাজি ফাটতে শুরু করে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ ভবানীপুরের বেণীনন্দন স্ট্রিটে খাস পুলিশ হাসপাতাল লাগোয়া এলাকায় শব্দবাজির আওয়াজে পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। হরিদেবপুর এলাকার এক বৃদ্ধ বলছিলেন, “মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছি। যত রাত বেড়েছে, মনে হয়েছে, মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ চলেছে চার দিকে।” মধ্য কলকাতার গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ, আর এন মুখার্জি রোড ও লাগোয়া এলাকাতেও সন্ধে সাতটায় পুলিশি চক্করের পরে শব্দতাণ্ডব শুরু হয়ে যায়।
গঙ্গার ও-পারে হাওড়া ময়দান, মধ্য হাওড়াও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজের নিরিখে প্রায় রণক্ষেত্রে পরিণত। চুঁচুড়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কন্ট্রোল রুম ও মনিটরিং সেল খুলেছে নিজেদের উদ্যোগে। সংস্থার পক্ষে অনুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “নির্বিচারে শব্দবাজি ফাটছে। পুলিশ-প্রশাসনের কোনও নজরদারি, কোনও বাধা নেই। এমনকী, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কন্ট্রোল রুমে অভিযোগ জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না।”
এর পর ছয়ের পাতায় পুলিশও মানছে, শব্দবাজি ফাটানো দেরিতে শুরু হলেও, রাত গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাতে আর লাগাম টেনে রাখা সম্ভব হয়নি। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তাও মানলেন, পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি তাণ্ডব। তবে তিনি বলেন, “এ বছর অনেক পরে নজরদারির কাজ শুরু হয়েছে। তাতেও যতটা খারাপ আশঙ্কা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি।”
রাত পৌনে ৯টায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আমাদের হিসেবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই। শব্দবাজি ফাটছে ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য বার যতটা শব্দ হয়, এ বার ততটা নেই।” তবে তিনিও মেনে নিয়েছেন, শব্দবাজি ফাটানো একশো শতাংশ বন্ধ করা সম্ভব নয়।
কেন? সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় বলেন, “এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে শব্দবাজির চাহিদা রয়েছে। সে জন্যই পুলিশি নজরদারি এড়িয়ে রাজ্যের উৎপাদকদের হাতে তৈরি পাঁচ টন বাজি কালীপুজোর দুপুরের মধ্যেই বাজারে বিক্রি হতে পেরেছে। এর বেশির ভাগটাই চকোলেট বোমা।” ১০০টি চকোলেট বোমার প্যাকেট এ দিনও গোপনে বিকিয়েছে। দাম ১০০ টাকা। বাবলাবাবু জানান, রাজ্যে মোট ছ’টন শব্দবাজি তৈরি হয়েছিল এবং এর মধ্যে কেবল এক টন পুলিশ বাজেয়াপ্ত করতে পেরেছে। বাকি যা শব্দবাজি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে, তার সবটাই তামিলনাড়ুর শিবকাশী থেকে এ রাজ্যে ঢুকেছে। তবে তার মধ্যে বেশির ভাগই এমন বাজি, যার শব্দ এখানকার চকোলেট, দোদমার থেকে বেশি, মেনে নিলেন বাবলাবাবু। তাঁর বক্তব্য, সেই বাজিগুলি বিক্রি হলে শব্দ আরও বেশি হত।
শব্দবাজির দৌরাত্ম্য কিছু এলাকায় যে সামান্য হলেও কমেছে, তা মানছেন সাধারণ মানুষও। এর আর একটা কারণ, কলকাতার রাস্তায় বিপুল পুলিশি বন্দোবস্ত। রাত দশটা নাগাদ পুলিশ ট্রেনিং স্কুল থেকে ‘আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল’ উড়িয়ে নজরদারি শুরু হয়। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র জানান, এ দিন বিকেল চারটে থেকে রাত ২টো পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.