প্রবন্ধ ২...
ডাকাত এবং পুলিশকে এক ঘাটে...
ড় হয়েছি পুরোপুরি পুলিশি আবহে, বিভিন্ন থানার কোয়ার্টার্সে। যতটা কাছে ছিল পুলিশ, ততটাই আসামিরা। পুলিশ আর ডাকাতের মতো এমন জবরদস্ত, ‘ইনটেন্স’ কালীভক্ত খুব কম দেখেছি। দুই জাতশত্রু, একই মহিলার পায়ে নতজানু!
ছোটবেলায় দু’এক জন পুলিশজেঠু বুঝিয়েছিলেন, “দ্যাখো মা, পুলিশ বা ডাকাত-মস্তান, দু’পক্ষেরই কাজ অন্ধকার জগৎ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। খতরনাক সব ব্যাপার। দু’জনেরই মনের ভিতর তাই সর্বক্ষণ একটা চাপা নিরাপত্তাহীনতা, একটা ভয় কাজ করে। লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশের মতো সৌম্য-শান্ত দেবীতে ঠিক ভরসা আসে না। ধারণা তৈরি হয় যে, ভয়ঙ্করদর্শন, উগ্রচণ্ডী কোনও ঠাকুরই একমাত্র বিপদে পড়লে রক্ষা করতে পারেন।”
এক কালে কালীপুজো করে লুঠতরাজ-খুনখারাপিতে বার হত ডাকাত আর ঠগিরা। সিঙ্গুরে সনাতন বাগদি-গগন সর্দারের কালীপুজো, কাঁচরাপাড়ার রঘু ডাকাতের কালী, চিৎপুরের চিতে ডাকাতের কালী, ত্রিবেণীতে বুধো ডাকাতের কালী, হুগলির জিরাটের কালাচাঁদ ডাকাতের কালী, ভবানী পাঠকের কালীপুজো... যে ডাকাতের নিজস্ব কালীপুজো ছিল না তার স্টেটাসও কম ছিল।
তার পর স্বাধীনতা আন্দোলন পর্বে ব্যাপারটা করায়ত্ত হল বাঙালি বিপ্লবীদের। কালীমূর্তির সামনে গুপ্তশপথ নিয়ে তাঁরা ত্রাস সৃষ্টির মন্ত্রে দীক্ষিত হতেন। হেমচন্দ্র কানুনগো লিখেছেন, কালীপুজো ক্ষুদিরামের খুব প্রিয় ছিল। স্বাধীনতার পরে সাধারণের কালীপুজোর পাশাপাশি ব্যাপক হারে কালীপুজোর দখল নিল পুলিশ। রমরমিয়ে বাড়তে লাগল থানা চত্বরে পুলিশের কালীপুজো। এটা চলল ভরপুর বাম যুগেই, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। যত দিন না সরকারি নিষেধাজ্ঞা এল। নিষেধ তুচ্ছ করে জেলায় কিছু থানার পুজো এখনও বেঁচে আছে। তাই বলছিলাম, পুলিশ আর মস্তানকে পাশাপাশি এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ছেড়েছেন শক্তিময়ী।
কথা বলতে গিয়ে কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তীর মনে পড়ে যাচ্ছিল চাকরির একেবারে প্রথম দিকের কথা। তখন থানা চত্বরে বেশ কিছু কালীপুজো হত। এখনও বেশির ভাগ থানার বড়বাবুদের ঘরে একটা কালীঠাকুরের ছবি থাকবেই। যে অফিসারের কাছে গৌতমবাবু প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বুঝলে বাবা, পুলিশের কাজ হল ডাকাত-মস্তান ধরা। সেই ডাকাত যদি পুলিশের থেকে শক্তিমান হতে কালীপুজো করে তা হলে তো পুলিশকেও আরও ঘটা করে কালীপুজো করতে হবে। এ হল শক্তিপ্রদর্শনের লড়াই।” অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ পুলিশ অফিসার জয়দেব চক্রবর্তী গল্প শোনাচ্ছিলেন কাঁকসা থানার কালীপুজোর। সেই পুজোর আড়ম্বর তাঁর এখনও মনে আছে। দূর-দূর গ্রাম থেকে লোক আসত পুজো দেখতে। প্রচুর খাওয়াদাওয়া হত। চাঁদা নিয়ে পুলিশ জুলুম চালাচ্ছে বলে অভিযোগও উঠত। আর এক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলছিলেন, থানা চত্বরে পুজোর দায়িত্বে থাকতেন মূলত কনস্টেবল আর হোমগার্ডরা। পাড়ার লোকও তাতে যোগ দিতেন কখনও ইচ্ছায়, কখনও অনিচ্ছায়।
কনস্টেবল দুবেজি, পাঁড়েজি সেই কবে বুঝিয়েছিলেন, ‘কালীপুজো করাটা আসলে ডাকাত-মস্তানদের লোকদেখানো চাল। ওরা মানুষকে বোঝাতে চাইত, ভয়াল দেবীর পুজো করে ওরা ভয়ানক শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে। এতে মানুষের মনে ওদের শক্তি সম্পর্কে অতিরিক্ত ভয় ঢুকে যেত। তখন পুলিশ ভাবল— ঠিক আছে ব্যাটা, তোর ঘরে যে ধন আছে আমার ঘরেও সে ধন থাকবে। লাগা কালীপুজো। দেখি কার পুজোর শক্তি বেশি। দেখি মা কালী কাকে বেশি আশীর্বাদ করেন।’ শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। লালবাজারের এক অফিসারের আরও স্পষ্ট বক্তব্য, “আচ্ছা, এ ভাবেও তো ভাবতে পারেন যে পুলিশরা এক-এক জন জামা-প্যান্ট পরা বাবা কালী। মা কালী যেমন অশুভ শক্তির বিনাশ করে দুর্বলকে রক্ষা করেন আমরাও সেই একই দায়িত্ব পালন করি। তাই আমরা কালীভক্ত হবই।”
শুনে হাসলেন সামাজিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক গৌতম ভদ্র: “পুলিশ আর ডাকাত আবার আলাদা কোথায়? অনেকের কাছে পুলিশই তো ডাকাতের মতো। দু’জনেই গুলি-বন্দুক চালায়, খুনোখুনি করে, ক্ষমতা জাহির করে মানুষের উপর, ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচার করে, তোলা আদায় করে। এরা যে একই দেবীকে বেশি মানবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখন দেখতে হবে কার কালীর বেশি জোর।”
মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায় অবশ্য পুলিশ আর ডাকাত, উভয়পক্ষেরই একটা ক্ষমতার খাঁই রয়েছে। পার্থক্যটুকু হল, পুলিশের ক্ষমতা সমাজ বা তার পেশার দেওয়া আর ডাকাতের হল জোর করে আদায় করা। একটা পর্যায়ে অনেক পুলিশ উর্দির জোরে বাড়তি ক্ষমতা দখল করে। অর্থাৎ, তারা যে একেবারে ভিন্ন মেরুতে অবস্থানকারী দু’পক্ষ, তা মোটেই নয়। আরও বেশি শক্তি পেতে এবং তা কুক্ষিগত রাখতে তারা দু’পক্ষ শক্তির দেবীর পুজো করে।
নারীবাদীরা অবশ্য বলতে পারেন, ডাকাত আর পুলিশ, দু’পক্ষই বাইরে যতই পেশির আস্ফালন করুক, মনে মনে নারীশক্তির আশ্রয়প্রার্থী। অন্য কোনও পুজোয় পুরুষকে এত গণহারে উপোস করতে দেখেছেন? অতএব, ডাকাত থেকে পুলিশ, সব রকমের (না কি, একই রকমের?) ‘পৌরুষ’কে পদানত করা কালো ঈশ্বরীর নামে জয়ধ্বনি দিন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.