প্রবন্ধ ১...
হুঙ্কার তুমি কোথা হইতে
জকাল কেউ আর প্রকৃত হুঙ্কার দিতে পারে না। হুম্ একটি অনুকার শব্দ। নিজস্ব কোনও অর্থ নেই। কিন্তু অর্থ না থাকলে শব্দের কি শক্তি থাকে না? সংস্কৃত ভাষায় হুম্ শব্দটিই এক ধরনের মন্ত্র। এই ‘হুম’-এর যখন কার বা কৃতকরণ হচ্ছে, তপোবনবাসী মুনিঋষিরা দুই অক্ষরের মন্ত্রটি উচ্চারণ করছেন, তাকেই বলে হুঙ্কার। মন্ত্রটি যে সাংঘাতিক, তার প্রমাণ মহাভারতের শান্তিপর্ব। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সমাপ্ত, বিজয়ী যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের দ্বারে। ব্রাহ্মণরা তাঁকে আশীর্বাদ করছেন, চার দিকে দুন্দুভি, শঙ্খধ্বনি ও জয়শব্দ। এমন সময় দুর্যোধনের বন্ধু চার্বাক (ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ-এর সঙ্গে এঁর সত্য বা কল্পিত কোনও সম্পর্ক নেই, ইনি অন্য চরিত্র) ভিক্ষুকবেশে এসে বললেন, “মহারাজ, ব্রাহ্মণরা আপনাকে জ্ঞাতিঘাতী বলে ধিক্কার দিচ্ছেন। আপনার মৃত্যুই শ্রেয়।” সমবেত ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে তখন লজ্জিত যুধিষ্ঠিরের কাতর অনুরোধ, “আপনারা আমার প্রতি প্রসন্ন হন। আমি এখনই জীবন বিসর্জন দেব, আর ধিক্কার দেবেন না।” তপঃশক্তিসম্পন্ন, বেদবিশারদ ব্রাহ্মণরা মুহূর্তে জ্ঞানচক্ষুতে চার্বাকের আসল পরিচয় জেনে নিলেন। তার পর, ‘ব্রাহ্মণগণ চার্বাককে ভর্ৎসনা করিয়া হুঙ্কার শব্দ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। চার্বাক সেই মহাত্মাদিগের ক্রোধাগ্নিতে দগ্ধপ্রায় হইয়া অশনিদগ্ধ পাদপের ন্যায় অচিরাৎ ভূতলে নিপতিত হইল।’ কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদে জানা গেল, যথার্থ হুঙ্কারে হুতাশনও প্রজ্বলিত হয়। মহাভারতের সংস্কৃত ‘ক্রিটিকাল এডিশন’ যিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন, সেই বিবেক দেবরায় জানাচ্ছেন, “ওই একটি জায়গা ছাড়া মহাভারতে আর কোথাও এত স্পষ্ট হুঙ্কার শুনিনি।”
এখনকার নেতাদের হুঙ্কারে আগুন জ্বালানোর সেই ম্যাজিক নেই। বাড়িতে বাবা, স্কুলে মাস্টারমশায় এবং অফিসে উপরওয়ালাও হম্বিতম্বি করতে পারেন, কিন্তু মহাভারতীয় হুঙ্কার ছাড়তে অপারগ।
হুঙ্কার পুরুষের একচেটিয়া নয়। মহিষাসুরের সঙ্গে দুর্গার যুদ্ধ। মহিষাসুরের সেনাপতি চামরাসুর দেবীর প্রতি অস্ত্র ছুড়ল। তার পরই শ্রীশ্রীচণ্ডী-র বর্ণনা: হুঙ্কারাভিহিতাং ভূমৌ পাতয়ামাস্ নিষ্প্রভাম্। মানে, দেবী হুঙ্কারনাদে সেই অস্ত্র প্রতিহত ও নিষ্প্রভ করে মাটিতে ফেলে দিলেন। তান্ত্রিক আরাধনায় যোগিনীরাও হুঙ্কার দিতেন। আজও কালীপুজোর তন্ত্র-মন্ত্র: হ্রীং হ্রীং হুম্ হুম্ ক্রীং ক্রীং ক্রীং দক্ষিণে কালিকা।
এই হুঙ্কারনাদ সবাই দিতে পারে না। আত্মিক শক্তি না থাকলে চেঁচানিই সার, গলা দিয়ে জীবনেও হুঙ্কার বেরোবে না। সংস্কৃত থেকে পালি হয়ে এক সময় তিব্বতি ভাষাতেও পৌঁছে গিয়েছে সেই জাগৃতির ধারণা। তিব্বতি সংস্কৃতিই পৃথিবীকে শুনিয়েছে সেই বিখ্যাত মন্ত্র: ওম্ মণিপদ্মে হুম্!
সারনাথের ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব হায়ার টিবেটান স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক পেন্পা দোরজির মতে, শেষের এই ‘হুম্’টিও অনুকার। আভিধানিক অর্থ নেই, কিন্তু তাৎপর্য বিপুল। হুম্ উচ্চারণে ভিতরের শত্রুতা এবং আগ্রাসী মনোভাব পরিশুদ্ধ হয়। তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামার মতে, হুম্-ই মন্ত্রের প্রাণশক্তি। বোধি এবং প্রজ্ঞার যখন পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে, চেতনায় সেই মুহূর্তে তারা অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংহত, এই সময়েই সকলের জন্য ‘করুণা’ জাগবে। উচ্চারণ করা যাবে যথার্থ হুম্। তিব্বতি বৌদ্ধ তন্ত্রের এই ব্যাখ্যা কি হিন্দু ধর্মেরই পরিপূরক নয়? দেবী নিশ্চয় শুধু শত্রুতা, ঘৃণা এবং আগ্রাসী মনোভাব থেকে হুঙ্কার দেন না। কোথাও নিশ্চয় চামরাসুর, মহিষাসুরদের জন্যও মায়া রহিয়া যায়! এই মঙ্গলকামিতা না থাকলে হুঙ্কার অর্থহীন। মহাযান করণ্ডব্যূহ সূত্রে গোতম বুদ্ধ বলছেন, সমস্ত প্রাণীর মঙ্গলের জন্য তিনি বহু বার মণিপদ্মে হুম্ উচ্চারণ করেছেন। শাক্যসিংহও একাধিক হুঙ্কার দিয়েছেন!
গোতম বুদ্ধ, অবশ্যই! বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে চৈতন্য থেকে বিবেকানন্দ সকলেই হুঙ্কার ছেড়েছেন। চৈতন্যচরিতামৃতেই আছে, ‘নাচে প্রভু হুঙ্কার গর্জন।’ কৃষ্ণপ্রেমে কায়মনোবাক্যে এক হয়ে গিয়েছেন শ্রীচৈতন্য, ভিতরের সদ্যোজাগ্রত ক্ষমতা থেকেই হুঙ্কার দিচ্ছেন তিনি। সংস্কৃতিবিদ্যার শিক্ষক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এখানে হুঙ্কার মানে চিৎকার নয়, বরং এক ধরনের গমক।
সোজা কথায় হুঙ্কার ধর্মনিরপেক্ষ। বৈষ্ণব-তান্ত্রিক ভেদ নেই। স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে গানেও আছে সন্ন্যাসীর হুঙ্কার-স্মৃতি: ‘অভীঃ অভীঃ হুঙ্কারনাদিত।’ হুঙ্কার ভাল না খারাপ, নির্ভর করে হুঙ্কারদাতার অবস্থানের ওপর।
হুঙ্কারের জোর অন্যত্র। শুধুই আভিধানিক, ব্যুৎপত্তিগত অর্থে আটকে থাকেনি সে। ধনুকে জ্যা রোপণ করে যুদ্ধঘোষণাই হুঙ্কার। পিণাকপানি শিব তাঁর ধনুকে তির ছুড়লে যে টঙ্কার উৎপন্ন হয়, তারই অন্য নাম হুঙ্কার। খেয়াল রাখতে হবে, কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ তাঁর পাঞ্চজন্য বা ভীম তাঁর পৌণ্ড্র শাঁখ বাজিয়ে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে আহ্বান করলেও সেটি নিছক শঙ্খনাদ। রণহুঙ্কার নয়। হুঙ্কার আসবে বক্তার ভিতর থেকে। বড় জোর শিবের ধনুকের ছিলায়। শাঁখ এক ধরনের অ্যামপ্লিফায়ার, সামান্য ফুঁতেই বেজে উঠবে। মানুষের অন্তরশক্তি সেখানে কোথায়?
আত্মশক্তিহীন যুগে যুদ্ধঘোষণার দ্বিতীয় অর্থই প্রধান। হিন্দি ভাষার প্রামাণ্য শব্দকোষ ‘নালন্দা বিশাল শব্দসাগর’-এ হুঙ্কারের প্রথম অর্থ: ললকার বা ঘোষণা। ‘রুদালি’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের যে ‘দিল হুম হুম করে’ গান, সেখানে হুমের অর্থ মন্ত্রোচ্চারণ নয়। হৃদয় ঘোষণা করছে, কেউ এসেছে।
তবে রাষ্ট্রভাষায় হুঙ্কারের জনপ্রিয় অর্থ অন্য। নালন্দা অভিধানের মতে: ভীত করনে কে লিয়ে শোর মচানা। ‘মানক হিন্দি কোষ’ও প্রায় এক কথা বলছে: ডাঁটনে, দাপটকে লিয়ে উগ্র আউর জোর শব্দই হুঙ্কার। মানে হিন্দিভাষী রাজ্যে হুঙ্কার দিলে কেউ আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ খুঁজবে না। কতটা দাপটের সঙ্গে উগ্র কথা বলছেন, সেটিই বিবেচ্য। বাংলা হুঙ্কারে উগ্রতা প্রধান নয়। ভারতচন্দ্র কোকিলের ডাকেও হুঙ্কার শোনেন, ‘কুহু কুহু কোকিল হুঙ্কারে।’ চৈতন্যচরিতামৃতে হুম্ শুধুই গর্জন নয়। সন্তোষ, স্বীকৃতি, সম্মতি জানাতে হুঁ হুঁ করাও হুঙ্কার। মনে পড়তে পারে শান্তিপুরবাসী অদ্বৈত আচার্যের হুঙ্কার, ‘সর্বশাস্ত্র বাখালেন কৃষ্ণভক্তি সার। শুনিয়া অদ্বৈত সুখে করেন হুঙ্কার॥
সন্তোষ, সম্মতির এই বহুত্ববাচক বাংলা হুঙ্কার অস্বীকার করে সে? লালমোহনবাবু ‘মণিপদ্মে হুম্’ মন্ত্রকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘ওম্ মণিপদ্মে হুম্ হুম্ হুমকি’ বলছিলেন। কিন্তু তখন তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না। মগনলাল মেঘরাজ এল এস ডি খাইয়ে দিয়েছিল। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র হাসেন, “আমার কাছে হুম্ একটাই। জয়ন্ত, মানিকের গল্পে পুলিশ অফিসার সুন্দরবাবুর হুম্! ওমলেট খেয়ে তৃপ্তিতে হুম্, ভয় পেলে হুম্, রহস্য জমে উঠলেও হুম্!” কে জানত, বাঙালি শিশুদের জন্য লেখা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গল্পই ভারতীয় হুঙ্কারে অন্য মাত্রা জুড়ে দেয়!

পুনশ্চ: হুঙ্কারে আত্মশক্তি প্রয়োজন। হিঙ্কারে নয়। ‘কামসূত্র’য় হিঙ্কারস্তনিতকূজিত-র কথা আছে। সুরতের সময় নারী, পুরুষের কণ্ঠে সম্মিলিত অস্ফুট ধ্বনিই হিঙ্কার। ‘হিন্দু’ ঐতিহ্য বলে, হুঙ্কার তপোবনে, হিঙ্কার শয়নগৃহে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.