সম্পাদকীয়...
সম্মোহনের চাল
কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হইবে দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, খেতাবের জন্য লড়িবেন বিশ্বনাথন আনন্দ ও ম্যাগনাস কার্লসেন। নরওয়ের কার্লসেন দাবার বিস্ময়-বালক, এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর র্যাংকিং সম্পন্ন খেলোয়াড়। কিন্তু এই সকল ছাপাইয়া আলোচনা চলিতেছে কার্লসেনের দৃষ্টির সম্মোহন-ক্ষমতা লইয়া! বহু দাবা-বিশ্লেষকের ধারণা, তিনি বিপক্ষের খেলোয়াড়কে সম্মোহিত করিয়া তাহাকে বিশ্রী ভুল করিতে বাধ্য করেন। এই বৎসরেরই এক প্রতিযোগিতায় কার্লসেনের বিরুদ্ধে মার্কিন গ্র্যান্ডমাস্টার হিকারু নাকামুরা একটি সানগ্লাস পরিয়া খেলিতে বসেন। যদিও তিনি বলিয়াছেন ইহা নিতান্তই আমোদের জন্য, অনেকের মতে ইহার মূল উদ্দেশ্য ছিল, কার্লসেনকে নিজের চক্ষু দেখিতে না দেওয়া এবং সম্মোহনের সম্ভাবনা বিনষ্ট করা। প্রবাদপ্রতিম দাবাড়ু ভিক্টর কর্শনয়-ও বলিয়াছেন, কার্লসেনের দাবা-প্রতিভা উল্লেখযোগ্য কিছু নহে, অথচ তিনি সর্বোচ্চ স্তরের সাফল্য ধারাবাহিক ভাবে অর্জন করিয়া চলিয়াছেন— ইহার মূলে সম্মোহন-ক্ষমতা, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীর চিন্তা পড়িয়া লইতে পারেন এবং অনায়াসেই তাহাকে পরাস্ত করেন। কর্শনয়ের মতে, আরও কয়েক জন প্রখ্যাত খেলোয়াড় এই ক্ষমতা ধরিতেন। এই বক্তব্য অনেকেই হাসিয়া উড়াইয়া দিলেও (এবং কর্শনয় প্রায়ই অন্যকে অপমান করিয়া অপার আনন্দ লাভ করেন এমন ধারণা প্রচলিত হওয়া সত্ত্বেও), বহু মানুষই মনে করিয়া থাকেন দাবায় সম্মোহনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রহিয়াছে, এবং বহু দাবাড়ু সম্মোহন এড়াইতে সানগ্লাস বা টুপি বা পরিয়া খেলিতে বসেন। ১৯৭৮-এ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আনাতোলি কারপভ-এর সহকারীর দলে খ্যাত সম্মোহক ডক্টর জুখার-কে লওয়া হইয়াছে দেখিয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী কর্শনয় প্রতিবাদ করেন ও এমন চশমা পরেন যাহাতে আয়নার ন্যায় কাচ বসানো, অর্থাৎ বিরোধী খেলোয়াড় নিজেকেই প্রতিফলিত দেখিতে পাইবেন।
আসল কথা, মানুষ অলৌকিকের ঘ্রাণ পাইলে ছাড়িয়া দিবে না। যে মনোবৃত্তি হইতে সাধুর স্বপ্নের উপর ভিত্তি করিয়া খননকার্য চলিতে থাকে ও বহু লোক নিশ্চিত হইয়া যায় সোনা মিলিবেই, সেই মানসিকতা হইতেই এই সকল সম্মোহনের গালগল্প উৎসারিত। দাবা একটি বিরল খেলা, যেইখানে ক্রীড়াবিদের ক্ষমতা ব্যতীত আর প্রায় কোনও কিছুই ফলাফলে থাবা বসাইতে পারে না। ইহা ফুটবল ক্রিকেট টেনিস নহে যে আবহাওয়া কোনও ভূমিকা পালন করিবে, বা মাঠ পিচ কোর্ট খারাপ বলিয়া স্বাভাবিক খেলা নষ্ট হইয়া যাইবে। ইহা টেবিল টেনিস বা ক্যারমও নহে যে দুর্ভাগ্যক্রমে ঘুঁটি বা বল বোর্ডের কোনায় লাগিয়া অপ্রত্যাশিত আচরণ করিবে। এই খেলায় ‘চান্স ফ্যাক্টর’ নাই। বোর্ডে হুবহু তাহাই ঘটিবে, যাহা দুই খেলোয়াড়ের মাথার মধ্যে ঘটিতেছে। তাই দাবায় মেজাজ হারাইলে খেলোয়াড়কে পতাকার অবস্থান লইয়াও চেঁচামেচি করিতে দেখা গিয়াছে (দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর দেশের ক্ষুদ্র পতাকা টেবিলের পাশে লাগানো থাকে)। নিখুঁত গণিতের ন্যায় এই খেলায় পরাজয়-অজুহাতের অভাবই বোধ হয় সম্মোহন-কাহিনি উসকাইয়া দেয়। রোচক আখ্যানগুলি লইয়া টানাটানিও হয় অধিক, কারণ দাবার চালগুলির নীরস ব্যবচ্ছেদ আমজনতার পক্ষে দুরধিগম্য, সাধারণত দাবাড়ুরাও রোনাল্ডো বা কোহলির ন্যায় মিডিয়া-বান্ধব রঙিন ব্যক্তিত্ব লইয়া ঘুরেন ফিরেন না। তাঁহারা শান্ত ও গম্ভীর হইয়া খেলেন, জয় বা পরাজয়ে বাহ্যিক ভাবে বিগতস্পৃহ বা নিরুদ্বিগ্নমনা মুখ লইয়া অবস্থান করেন; আকাশে মুষ্টি তুলিয়া লাফান না, হাহাকার করিয়া মাটিতে মুখ ঘষেন না। আধুনিক ধমাকা-জমানায় ইহা ‘অ-ক্রীড়াসুলভ’, উদ্ভট, পানসে, যেইখানে দর্শককে নির্দিষ্ট ম্যাচের গতি ও গতিকের আন্দাজ পাইতে গেলে, উত্তেজিত হইয়া উঠিতে গেলে, খেলাটি অনেকখানি বুঝিতে হয়। তাই এই খেলায় সহসা রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের ইঙ্গিত পাইলে তাহা লইয়া দীর্ঘ পশম বুনিবার লোভ সামলানো অসম্ভব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.