বিদ্যুৎ বিক্রি করে যে টাকা পাওয়ার কথা, তা মিলছে না কিছুতেই। সরবরাহ করা বিদ্যুতের অনেকটাই কী ভাবে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সেই ফাঁক-ফোকর ধরতে এ বার এনার্জি অডিট শুরু করছে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। রাজ্যের ৬১টি ছোট শহরে এই কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। সংস্থার দাবি, সংবহনের ক্ষতি এক শতাংশ কমাতে পারলেই বছরে তাদের ৬৮ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে।
বণ্টন সংস্থার এক কর্তা জানান, ৩০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস, এমন শহরগুলিতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে, তার কয়েক হাজার ইউনিটের দাম মাসের শেষে পাওয়া যাচ্ছে না। কেন পাওয়া যাচ্ছে না, তার হদিস পেতেই এনার্জি অডিট হবে। পাশাপাশি, ওই শহরগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে সংবহনজনিত যে ক্ষতি (টেকনিক্যাল লস) হচ্ছে, তা কমিয়ে আনার জন্য পরিকাঠামোকেও ঢেলে সাজা হচ্ছে। এর জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হবে বলে ওই কর্তা জানান।
সম্প্রতি সংস্থা কর্তৃপক্ষ একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, এই রাজ্যের ছোট শহরগুলিতে সংবহনজনিত ক্ষতির গড় দাঁড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ওই ধরনের শহরে ১০০ টাকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয় হচ্ছে ৮৫ টাকা। বাকি ১৫ টাকার বিদ্যুৎ হয় চুরি হচ্ছে, কিংবা অন্য কোনও ভাবে শেষ পর্যন্ত ক্ষতির খাতাতেই চলে যাচ্ছে। এনার্জি অডিটের মাধ্যমে সেই ক্ষতির বহর কমিয়ে আয় বাড়ানো যাবে বলে আশা বণ্টন সংস্থার।
সংস্থা সূত্রের খবর, পুরনো ট্রান্সফর্মারগুলি বদলে ফেলার পাশাপাশি দুর্বল ওভারহেড লাইন ও সাবস্টেশনগুলিরও আধুনিকীকরণ করা হবে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের লাইন এক টানা অনেক দূর গিয়েছে। সেগুলিকেও মাঝপথে কেটে নতুন ট্রান্সফর্মারের সঙ্গে যোগ করে তাদের সংবহন শক্তি বাড়ানো হবে। এ ছাড়া, প্রতিটি ট্রান্সফর্মারের উপরে বসানো হবে এমন এক ধরনের মিটার, যার মাধ্যমে ওই লাইনে প্রতি দিন কত বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছে সেই তথ্য মিলবে। এমনকী, প্রয়োজনে পাড়া ধরে ধরেও বিদ্যুৎ বিক্রির হিসেব মিলবে ওই মিটারের মাধ্যমে। আধুনিকীকরণের এই কাজের জন্য সংস্থা কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের খুঁটি, ট্রান্সফর্মার বা সাবস্টেশনের ভৌগোলিক মানচিত্রও তৈরি করে ফেলেছে। ওই শহরগুলির গ্রাহকদের নাম-ঠিকানা, মাসে তাঁদের বিদ্যুৎ খরচের গড় হিসাব নিয়েও তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। |
ক্ষতির শীর্ষে |
শহর |
পরিমাণ (হিসেব শতাংশে) |
ঔরঙ্গাবাদ |
৬০ |
বরাকর |
৫০ |
আসানসোল |
৪৮ |
রঘুনাথগঞ্জ |
৪৩ |
জঙ্গিপুর |
৩৮ |
বিষ্ণুপুর |
৩৫ |
ডায়মন্ড হারবার |
৩০ |
|
সংস্থা তার সমীক্ষায় পেয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ করেও যে সব শহর থেকে যথেষ্ট আয় হচ্ছে না, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বর্ধমান জেলার আসানসোল, বরাকর বা মুর্শিদাবাদের ঔরঙ্গাবাদের মতো শহর। সেখানে বণ্টন সংস্থার বিদ্যুৎ বিক্রি করে অর্ধেকও আয় হয় না। ঔরঙ্গাবাদে ১০০ টাকার বিদ্যুৎ বিক্রি করলে ৬০ টাকাই ‘জলে’ যায়। অথচ শিলিগুড়ি বা বিধাননগরের মতো শহরে গড় ক্ষতির পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ, জলপাইগুড়িতে ২০ শতাংশ।
কিন্তু এনার্জি অডিট করে কি ক্ষতির বহর কমানো যাবে? বণ্টন সংস্থার এক কর্তা বলেন, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ চুরি রোখা যাচ্ছে না। হুকিং রোখার অভিযান আপাতত বন্ধ। এই অবস্থায় ছোট শহরগুলিতে ক্ষতি কমানোকেই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মনে করা হচ্ছে। কর্তাটির অভিযোগ, ছোট শহরগুলিতে এমন বহু নার্সিংহোম, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিয়েবাড়ি, ছোট কারখানা বা বড় দোকান রয়েছে যারা মিটারে কারচুপির করে বিদ্যুৎ চুরি করে। এনার্জি অডিটে যা ধরা পড়বে।
সারা রাজ্যে এখন সংবহনজনিত ক্ষতির গড় দাঁড়িয়েছে ৩০-৩২ শতাংশের ঘরে। গত দু-তিন বছরের মধ্যে এই ক্ষতির বহর বাড়ার ফলে বণ্টন সংস্থা এখন প্রবল আর্থিক টানাটানির মধ্যে পড়ে গিয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে সংস্থা চালাতে গিয়ে বার বার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় ক্ষতির বহর কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিল আদায়ের উপরেও জোর দিচ্ছে বণ্টন কর্তৃপক্ষ। |