জেসপ কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে অনুমতি চাইলেন সংস্থা কর্তৃপক্ষ। আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে কারখানা বন্ধ করে দিতে চান তাঁরা। এই মর্মে গত ৩১ অক্টোবর রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে সংস্থার তরফে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছে। এর ফলে সংস্থার ৬৫০ কর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ার মুখে।
তবে রাজ্য সরকার জেসপ বন্ধের অনুমতি দেবে না বলেই জানিয়েছেন পূর্ণেন্দুবাবু। শনিবার তিনি বলেন, “২ নভেম্বর পর্যন্ত ওই চিঠি রাজ্য শ্রম দফতরে পৌঁছয়নি। কোনও সংস্থা বন্ধ করতে হলে কমপক্ষে ৬০ দিনের নোটিস দিতে হয়। তা ছাড়া কর্মীদের বকেয়াও মেটাতে হবে কর্তৃপক্ষকে। পাশাপাশি মেটাতে হবে কর ইত্যাদি বাবদ রাজ্য সরকারের পাওনা। প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইএসআই বাবদ বহু কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন জেসপ কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ব্যাঙ্ক এবং অন্য পাওনাদারদের বকেয়া তো রয়েছেই।” একই সঙ্গে পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “আমি চাই জেসপ চালু থাকুক। শান্তিপূর্ণ ভাবে শ্রমবিরোধ মেটানোর ব্যবস্থা করা হোক।”
দু’শো বছরেরও বেশি পুরনো জেসপ সংস্থা বন্ধ করার কথা কেন ভাবছেন কর্তৃপক্ষ?
এ দিন সংস্থার তরফে জানানো হয়, “জেসপের দমদম কারখানায় চূড়ান্ত অরাজকতা চলছে। অফিসারদের মারধোর করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোনও সুরাহা হয়নি। কারখানার উৎপাদন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর ফলে চূড়ান্ত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে সংস্থাকে। এই অবস্থায় কারখানা চালানো সম্ভব নয়।”
কর্তৃপক্ষের এই অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ কারখানার ইউনিয়ন। বিশেষ করে অফিসারদের মারধোর করার অভিযোগ উড়িয়ে কারখানার তৃণমূল ট্রেড ইউনিয়ন অনুমোদিত জেসপ ওয়ার্কার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সহ-সভাপতি শ্যামল রক্ষিত বলেন, “গত তিন মাস ধরে সাব-স্টাফদের বেতন দেওয়া হয়নি। কারখানার কর্মীরা গত দু’মাসের বেতন পাননি। বেশ কয়েক বছর আমরা বোনাসও পাইনি। তা ছাড়া যাঁরা অবসর নিয়েছেন, তাঁদের বকেয়াও মেটাননি কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি কিছু কর্মীকে অন্য রাজ্যে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এটা শাস্তিমূলক বদলি। কারণ যেখানে বদলি করা হয়েছে, সেখানে কোনও কাজ নেই।” শ্রমিকরা কাজ করেন না বলে সংস্থার তরফে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা-ও মানতে নারাজ ইউনিয়ন। শ্যামলবাবুর অভিযোগ, “কারখানায় উৎপাদন চালু রাখার ইচ্ছাই কর্তৃপক্ষের নেই। মেশিনপত্র রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। উৎপাদনের জন্য কাঁচামালও দেওয়া হয় না।”
জেসপে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উৎপাদন ভিত্তিক বেতন চালু করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ইউনিয়ন তা মানতে চায়নি। এই অবস্থায় গত ২৪ অক্টোবর শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে এবং ৩০ অক্টোবর ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন শ্রমমন্ত্রী। এ দিন পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “জেসপ কর্তৃপক্ষ উৎপাদন ভিত্তিক বেতন অথবা ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁদের আরও প্রস্তাব ছিল, মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি না করার। আমার পক্ষে ওই প্রস্তাবগুলি মানা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া বৈঠকে জেসপের পক্ষে এমন কেউ আসেননি, যাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। আমি বলেছিলাম, বিরোধের মীমাংসা করার জন্য সংস্থার ডিরেক্টর স্তরের কেউ এসে আমার সঙ্গে আলোচনা করুন। কিন্তু তার পরিবর্তে কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন জেসপ কর্তৃপক্ষ!”
ওয়াগন তৈরির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা জেস প ৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে ধীরে ধীরে রুগ্ণ হয়ে পড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে সংস্থাকে বিআইএফআরে পাঠানো হয়। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সংস্থাটি হাতে নেয় পবন রুইয়া গোষ্ঠী। শনিবার জেসপের এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন, “জেসপ হাতে নেওয়ার পর আমরা এ পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকারও বেশি লগ্নি করেছি। গত এক বছরেই ৫০ কোটি টাকা লগ্নি করা হয়েছে। প্রতি মাসে বেতন বাবদ দিতে হয় প্রায় ২ কোটি টাকা। ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে আমরা যে বেতন দিই, তা প্রথম সারির সংস্থাগুলিতেই দেওয়া হয়। আমাদের বরাতের অভাব নেই। টাকাও লগ্নি করতে আমরা ইচ্ছুক। কিন্তু অফিসারদের মারধোর করা হলে এবং উৎপাদন ঠিক মতো না হলে কারখানা চালানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
তবে জেসপ এখনই বন্ধ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ রাজ্য ওই অনুমতি দিতে রাজি হবে না বলেই সরকারি সূত্রের খবর। সে ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’ ঘোষণা করতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে কর্মীদের একাংশের মধ্যে। পূর্ণেন্দুবাবু জানান, জেসপ কর্তৃপক্ষের চিঠি হাতে এলেই তিনি ফের সংস্থাটির কর্তাদের আলোচনার জন্য ডেকে পাঠাবেন। একই সঙ্গে কারখানা চালু রাখতে ইউনিয়নের সঙ্গেও আলোচনায় বসবেন। |