|
|
|
|
স্মরণ |
কেন যে মুম্বই ছেড়ে চলে গেলেন |
শেষ জীবনে মান্না দে-র দুর্দশার খবর পড়ে চোখের জল ধরে রাখতে
পারলেন না আরতি মুখোপাধ্যায়। বললেন সংযুক্তা বসু-কে। |
ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা সায়েন্স সিটিতে। একটা অনুষ্ঠানে। দু’ বছর আগে। আমি গিয়ে দেখা করতেই বললেন, এতক্ষণে এলে? যাও গিয়ে সিটে বোসো। একদম বৌদির পাশে বসবে।
সে দিন মান্নাদাকে দেখে খানিকটা বার্ধক্যগ্রস্ত মনে হলেও, ওঁর মধ্যে প্রাণ আর আন্তরিকতার কোনও অভাব দেখিনি। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে একটা কথা ভেবে। যে মানুষটা সারা ভারতের এত শ্রোতার সুখ-দুঃখের সমব্যথী হয়ে গান গেয়ে মাত করে এলেন, এত বছর ধরে, পেছনে ফেলে গেলেন এত ভাবশিষ্যকে, শেষ মুহূর্তে সেই আমরা যারা ওঁর কাছে কোনও না কোনও ভাবে ঋণী, তারা কেউই কিছুই করতে পারলাম না।
বিশ্বাস করুন, আনন্দবাজারে ওঁর শেষ জীবনের দুর্দশার খবর পড়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। বুকটা যেন ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে। এমন একজন দরদি শিল্পী যিনি চিরকাল সব মানুষের খবর রাখতেন তাঁর জীবনের এই পরিণতি?
আসলে বেঙ্গালুরুতে মান্নাদার শেষ দিনগুলোয় যা ঘটেছিল আমরা মুম্বইবাসী শিল্পীরা নানা গুঞ্জনে কিছু কিছু আগে জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস হয়নি। দিনের পর দিন ফোন করেছি। বেজে গেছে শুধু। কেউ ফোন ধরত না। একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়িকা শুনলাম মান্নাদার জন্মদিনে ওঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়ে শেষমেশ বাড়িতে ঢুকতে না পেরে জানলা থেকে শুভেচ্ছা আর প্রণাম জানিয়ে চলে আসেন। সেই শিল্পী মান্নাদার অত্যন্ত কাছের মানুষ। বছরের পর বছর দাদার সঙ্গে বিদেশে গান গেয়েছেন।
মুম্বই ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মান্নাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন যাচ্ছেন দাদা? উনি বলেছিলেন, সুমিতা (ছোট মেয়ে) ওখানে কিছু কাজটাজ করতে চায়। তাই আমরাও চলে যাচ্ছি। ওকে তো আমরা একা ছেড়ে দিতে পারি না।
মেয়েদের জন্য কত যে কাতর থাকতেন, বলার নয়। এখনও মনে পড়ে। মান্নাদার সঙ্গে হয়তো শহরের বাইরে কোথাও শো- করতে গিয়েছি। অনেক দিন বাড়ি থেকে দূরে আছেন। বলতেন, কত দিন হয়ে গেল মেয়ে দুটোকে দেখি না। কবে যে বাড়ি যাব!
একই সঙ্গে স্নেহবৎসল আর রসিক মান্নাদার সঙ্গে আমার আলাপ বহু কাল আগে। তখন আমার বয়স বছর পনেরো কী ষোলো। এক সর্বভারতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় মেয়েদের বিভাগে প্রথম হওয়ার পর ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। নিজে ফোনে দাদুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আমাকে গান গাইতে নিয়ে যান আফ্রিকায়। সঙ্গে বৌদিও ছিলেন (সুলোচনা দেবী)। এত ব্যথা এত তিক্ততার পরও যা থেকে যায় তা ওঁর গান। আর আমাদের মান্না-উত্তরাধিকার। যা মানুষ মান্নাদার শত লাঞ্ছনাতেও অম্লান থাকবে। সেইখানেই যে মান্নাদা জিতে গেলেন। একেবারে অলৌকিক ভাবে।
সত্তর বছর বয়সেও গান শিখতেন
শিল্পীমনন কী করে তৈরি করতে হয়, তা মান্নাদা’র কাছেই শেখা। কেন শ্রোতারা তাঁকে মনে রাখবেন, কী শিক্ষা আমরা তাঁর কাছ থেকে নেব বলতে গেলে প্রথমেই যেটা মনে পড়ে, তা হল ওঁর শেখার অদম্য ইচ্ছের কথা। ক্ল্যাসিকাল গানের ভেতর দিয়েই জনপ্রিয় গানকে তুলে ধরার গায়কীকে বজায় রাখতে সত্তর বছর বয়সেও উনি গুরুর কাছে গান শিখেছেন। নিজেকে ধন্য মনে করতেন মহমম্দ রফির মতো শিল্পীর প্রতিবেশী হওয়ার জন্য। সেই মানুষটার কাছে শেষ জীবনে হারমোনিয়ামটাও ছিল না। ভাবা যায়! মনে পড়ে প্রথম যখন মুম্বই গেলাম ওঁর বাড়িতে ছিলাম তিন দিন। প্রতিদিন ভোরে আমাকে হারমোনিয়াম নিয়ে বসিয়ে দিতেন। বলতেন, “ভোর হয়ে গিয়েছে। রেওয়াজ করো। সময় চলে যাচ্ছে।”
ওঁর এই নিয়মিত রেওয়াজের ছাপ পড়েছে প্রতিটা গানে। ক্ল্যাসিকাল শিখলেও আধুনিক গানে বা ফিল্মি গানে সেই জ্ঞানকে কখনও বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করতেন না। সব সময় খেয়াল রাখতেন শ্রোতার কথা। তাঁদের কাছে গান যেন দূরের না মনে হয়, সেই কথা। ‘সুন্দরী গো দোহাই দোহাই’, ‘রঙ্গিনী কত মন’, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’, ‘এ কী অপূর্ব প্রেম দিলে’ সবের মধ্যেই মধুর ভাবে বয়ে গেছে ক্ল্যাসিকালের চোরাস্রোত। কিন্তু কোথাও উনি ওঁর শাস্ত্রজ্ঞানকে জাহির করেননি। সেই জন্যই গানগুলো আলাদা হয়ে যায় অন্য আধুনিক গান থেকে। |
|
উত্তম-সৌমিত্রের লিপে ওঁর বাংলা গান মানুষ মনে রাখবে
উত্তমকুমারের লিপে ‘স্ত্রী’, ‘নিশিপদ্ম’ সন্ন্যাসী রাজা’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘শঙ্খবেলা’র গানে শাশ্বত বা চিরকালীনের ছোঁয়া আছে বলেই তো আজও মানুষ মনে রেখেছে। বাংলা ছবির প্লেব্যাকে মান্নাদার গান একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। একটা অন্য ধারা সঞ্চার করেছিলেন রুপোলি পরদায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতেও ওঁর গান জনপ্রিয় হয়েছে। এখনও কত তরুণতরুণীর রিংটোনে আছে ‘হয়তো তোমারই জন্য’। তেমনই পপুলার হয়েছিল ‘বসন্ত বিলাপ’-য়ের ‘লেগেছে লেগেছে আগুন লেগেছে’ গানটাও। এখানেও সেই একই ব্যাপার। প্লে-ব্যাকে খুব মাধুর্যের সঙ্গে ক্ল্যাসিকাল মিলিয়ে দেওয়া। যেটা আগে কমই হয়েছে।
ছিল ইমপ্রোভাইজেশনের অসীম ক্ষমতা
‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে বেঁধো না ফুল মালা ডোরে’ গানটা রেকর্ডিং হওয়ার আগে সুরকার নচিকেতা ঘোষ বলেছিলেন গানটায় দুটো অন্তরা। কিন্তু তার মাঝখানে কিছু অন্যরকম সুরের খেলা দরকার। মান্নাদা আমাকে আমার উস্তাদজি সাগিরউদ্দিন খান সাহেবকে ডেকে আনার অনুরোধ করলেন। উস্তাদজি আসার পর ওঁকে গানখানা শুনিয়ে অনুরোধ করা হল গানের সুরের সঙ্গে মানানসই কিছু সরগম করতে। সেই সরগম শুনেই মান্নাদা ধরে ফেললেন কী ভাবে সুর লাগাতে হবে। আমি যখন গাইলাম ‘ও কালো রূপের ছটা....’। উনি সেইখান থেকে আলাপ করে চলে গেলেন একেবারে তারার পঞ্চমে। তার পর নিষাদ ছুঁয়ে চলে এলেন মুদারার গান্ধারে। সে এক অপূর্ব মাদকতা খেলে গেল গানের মধ্যে। তার পর শুরু হল অন্তরা। অসাধারণ ভাবে শেষকালে গানটা দাঁড় করিয়ে দিলেন মান্নাদা। এই ভাবে কত গান মূল গীতিকারের কথা, সুরকারের কম্পোজিশন বজায় রেখেই নিজে ইমপ্রোভাইজ করেছেন, গুনে শেষ করা যাবে না।
পারফেকশনের পৌঁছানোর সিঁড়ি ভেঙে চলা ক্রমাগত
যে গানই গাইতেন যতক্ষণ না নিজের পুরোপুরি মনঃপূত হচ্ছে লেগে থাকতেন। শুনেছি ‘মর্জিনা আবদাল্লা’র, ‘বাজে গো বীণা’ গানটা নিয়ে বসার পর হঠাৎ সুরকার-গীতিকার সলিল চৌধুরীকে বললেন, এ কী! এই গানের মধ্যে ‘তুম না তুম না না না তুম না না না বোল’ লাগিয়েছেন কেন? এ তো তবলার বোল। সলিলদা বলেছিলেন, গানের কথাকে মেলাতে হবে তো। মান্নাদা তবলার বোল বললেও আমরা তারানাতেও তো এই ধরনের বোল গেয়ে থাকি। তবুও মান্নাদা খুঁতখুঁতে ছিলেন বলেই বলেছিলেন। পরে আবার গানটা গেয়েওছিলেন অসাধারণ ভাবে। মুম্বইতে নানা সময়ে যখনই দেখা হয়েছে বলতেন, গানবাজনা চলছে তো? নিখুঁত ভাবে চালিও যাও। কখনও ওঁর সঙ্গে ডুয়েট গাইতে গিয়ে হয়তো ওঁর দিকে তাকিয়েছি। মান্নাদা বলতেন, মাইকের দিকে তাকিও গাও। মাইককে বিলাভেড ভাব। জিম রিভস, ন্যাট কিং কোল, হ্যারি বেলাফন্টে, এলভিস প্রেসলির গানের ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা। আমার সঙ্গে ওয়েস্টার্ন গান নিয়ে অনেক সময়ই কথা হত। উনি বলতেন, “পপ গাইতে গেলে ওয়েস্টার্ন শুনতেই হবে। শুধু ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে থাকলে চলবে না। ‘আও টুইস্ট করে’ থেকে ‘আমি আগন্তুক বার্তা দিলাম’ কিংবা ‘জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’ এ সব গানের জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে পশ্চিমি গানের মূর্ছনাকে বাংলা বা হিন্দি গানে হালকা করে ভাসিয়ে দেওয়ার মৌতাত।
বৈঠকী মেজাজের গানে আসর মাতানো
একটা সময় যে ঠুমরি-টপ্পা জড়িয়েছিল কলকাতার বাবু কালচারের সঙ্গে, সেই ধারাকে বাংলা গানের মধ্যে আধুনিক একটা চেহারা দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন মান্নাদা। ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’, ‘কাহারবাঁ নয় দাদরা বাজাও’, ‘যেমন সাপিনীকে পোষ মানায় ওঝা’, ‘আমি যে জলসাঘরে’, ‘জরোয়ার ঝুমকো থেকে’, ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’এসব গানই তো সেই পুরনো কলকাতার বৈঠকি মেজাজের গানকেই মনে করায়। কিংবা ‘ও ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’ এ তো বিখ্যাত প্রাচীন ঠুমরি। কিন্তু পুলক বন্দ্যোপাধ্যয় এ গানকে নতুন করে লিখেছিলেন মান্নাদার জন্য।
এ গানের চমক-ঠমক-লাস্য মান্নাদার মতো মার্গসঙ্গীত শাস্ত্রপণ্ডিতের গলায় যেন আরও দুর্দান্ত হয়ে উঠেছিল।
অন্য শিল্পীর কদর আর রোম্যান্টিকতা
মুম্বইতে মান্নাদা থাকতেন মহমম্দ রফির উলটো দিকের বাড়িতে। সব সময় বলতেন, আমার কী সৌভাগ্য যে আমি ওঁর প্রতিবেশী। ওঁর মতো গলা যদি পেতাম! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রোম্যান্টিক গলারও অসম্ভব ভক্ত ছিলেন মান্নাদা। বলতেন, কী গলা হেমন্তের! আবার মেহেদি হাসানের গজল শুনতে শুনতেও বিভোর হয়ে যেতেন কখনও।
রোম্যান্টিক গানে মান্নাদা যে কতটা সফল, তার অগণিত প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বাংলা গানে। তার মধ্যে তিনটে গানের কথা না বলে পারছি না। ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘হয়তো তোমারই জন্য’ আর ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’।
কিন্তু এই রোম্যান্টিকতা অনেক সময় তাঁকে রীতিমতো চর্চা করে গানে নিয়ে আসতে হত। একবার মনে পড়ে ‘দস্যু রত্নাকর’ ছবিতে নচিকেতা ঘোষের সুরে টোরি রাগের ওপর একটা গান ছিল ‘আমার জলে ভেজা অঙ্গে।’ গানটার প্রথম কলি ছিল এইরকম। আমি আর মান্নাদা গাইছি গানটা। ভীষণ রোম্যান্টিক গান। বারবার গাইছেন মান্নাদা। আর নচিদা বলছিলেন, ঠিক ‘মান্না দে’ বলতে যা তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ এ সব বলার পর নচিদা বলেই ফেললেন, আপনি মান্নাদা একটু বৌদির সঙ্গে রোমান্টিক মুহূর্তের কথা ভাবুন তো। নিভৃতে ওঁর সঙ্গে যে ভাবে কথা বলতেন, সেই ভাবে গানটা করুন না। এ গানে টোরির ব্যবহার আছে ঠিকই কিন্তু সেটা উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব বা উস্তাদ আমির খানের টোরি নয়। এ হল ক্ল্যাসিকাল না জানা সিনেমার পরদার দুই ছেলেমেয়ের টোরি। অমনি মান্নাদা ধরে ফেললেন এবং গেয়েও দিলেন।
আবার ধরা যাক ‘অভিমানে চলে যেও না’র মতো গান। প্রেমিক মনের দরদের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন চর্চা করা ক্ল্যাসিক্যালের রেশ। যেটা গানের মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকত। কিছু কিছু গানের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, মান্নাদা শুধু গাইতেন না, রীতিমতো যেন অভিনয় করতেন। সলিল চৌধুরীর সুরে ‘মানব না এ বন্ধনে’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘আয়রে কুড়ুল করাত নিয়ে’ কিংবা সুধীন দাশগুপ্তর সুরে ‘আমি শ্রী শ্রীভজহরি মান্না’, ‘আমি কোন পথে যে চলি’ গানগুলো খেয়াল করুন। দেখবেন মান্নাদার গায়কীর মধ্যে ওঁর অভিনয় সত্তাকে খুঁজে পাবেন। গান গাইতে বসে রীতিমতো যেন ‘অ্যাকটিং’ করে গিয়েছেন মান্নাদা।
মান্নাদা জাতীয় সম্পদ। কোনও পরিবারের বিধিনিষেধের শেকলে তাঁর বাঁধা থাকার কথাই তো ছিল না।
শুধু আফশোস এই, কেন যে তিনি মুম্বই ছেড়ে চলে গেলেন! যদি এখানে আমাদের মাঝখানে থাকতেন, তা হলেও শেষ জীবনটা হয়তো এত বিচ্ছিন্নভাবে কাটত না। অনেক বেশি মসৃণ হত ওঁর শেষ বিদায়ের পর্ব।
|
আরতি মুখোপাধ্যায়ের ছবি তুলেছেন অমিত রায়। |
|
|
|
|
|