|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
মনমোহনের চোখ বইয়ের পাতায় মর্নিং ওয়াকে বাজপেয়ী |
বিদেশে গিয়ে কাজের শেষে
কী করেন ওঁরা? লিখছেন
পঞ্চাশেরও বেশি সফরে
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী-সাংবাদিক
জয়ন্ত ঘোষাল। |
দর্শন বলে প্রতিটি মানুষই আসলে ভিন্ন। যমজ ব্যক্তিরাও স্বকীয় সত্তা।
তাই এক-এক জন প্রধানমন্ত্রীও এক-এক রকম।
একই দেশ মরিশাস। একই রকম নীল সমুদ্র সফেন সে দেশে মনমোহন সিংহ আর অটলবিহারী বাজপেয়ী দু’জনের সফর দু’রকম। একবার গিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে। অপরূপ সৌন্দর্য। তখন প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু। কাজ শেষে সমুদ্র সৈকতে সন্ধ্যাবেলায় অসাধারণ আড্ডা চলছে। সাংস্কৃতিক একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বিদেশ মন্ত্রক। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ব্যস্ত নানা ধরনের বৈঠকে।
ফেরার সময় প্রধানমন্ত্রী এলেন সফররত সাংবাদিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে। খোঁজ নিচ্ছিলেন প্রবাসে কার কেমন কাটল। সেই সুযোগেই তাঁকে প্রশ্ন, মরিশাসের সমুদ্র দেখলেন?
মনমোহনের জবাব, দেখলাম তো হোটেলের জানালা দিয়ে।
কাজ শেষে সন্ধ্যায় আমরা যখন সমুদ্র সৈকতে হইচই করছিলাম, তখন হোটেলের ঘরে ফিরে আপনি কী করছিলেন?
সে বার স্ত্রী গুরশরণ কউরও ওঁর সঙ্গে যাননি। ওঁর মেয়েরাও ছিলেন না কেউ। জবাব দিলেন, একটা বই পড়ে শেষ করে ফেললাম।
কী বই?
মরিশাসের ইতিহাস।
এই হলেন মনমোহন সিংহ। সংবাদমাধ্যমের কাছে আপাতভাবে তিনি বর্ণহীন। নো-কালার।
আবার এই মরিশাসেই অন্য এক বার। এ বার অটলবিহারী বাজপেয়ী। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। মরিশাসে গিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। তখনই শোনা গেল, বাজপেয়ী ভোরবেলায় সমুদ্রতটে গিয়েছিলেন সূর্যোদয় দেখতে। মর্নিং ওয়াক। একেবারে জিন্স-টিন্স পরে। তখন উনি জিনসও পরতেন। চিত্তাকর্ষক চরিত্র। ওঁর জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য সাধারণত ওঁর সফরসঙ্গী হতেন। জামাতাকে খুব ভালবাসতেন তিনি। |
|
অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী। |
বাজপেয়ী ভোজনরসিক। যখন যে দেশে যেতেন, সে দেশের খাবার পরখ করতেন। একবার দেখলাম, ব্যাংককে গিয়ে কাঁকড়া খেলেন। তখন শরীর ফিট ছিল। আমিষ খেতেন। লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো নিরামিষাশী ছিলেন না। পরে অবশ্য স্বাস্থ্যের কারণে আমিষ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে যে কোনও শীর্ষস্তরের কূটনৈতিক বৈঠকের সময় রেকাবিতে দেওয়া কাজু কিশমিশের প্রতি তাঁর ছিল অদম্য টান! তা সে হোয়াইট হাউস-এর বৈঠকই হোক বা অন্যত্র কোনও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা।
এমনকী দেশে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সময়ও মুঠো মুঠো কাজু নিতেন বাজপেয়ী! তাঁর সঙ্গে সফররত চিকিৎসকের মাধ্যমে বিদেশের প্রোটোকলকে জানিয়ে সেই কাজু পরিবেশন বন্ধ করা হয়েছেএমনটাও দেখেছি!
প্রধানমন্ত্রী হলেন ভারতের প্রশাসনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। সেই মানুষ যখন বিদেশ যান, তখন সে এক অবাক করা বিহার। আগেকার দিনের রাজারা যখন যুদ্ধে যেতেন, তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যেত বিশাল হাতি-ঘোড়ার কনভয়।
আধুনিক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ যাত্রাও এক মেগা-ইভেন্ট। এয়ার ইন্ডিয়ার বিশাল এয়ারবাস প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করা হয়। সেই বিমানটিতে থাকে দুটো ফ্লোর।
দোতলায় প্রধানমন্ত্রীর মহারাজ স্যুইট। সেখানে শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা সবই আলাদা। দেখতে লাগে ঠিক বাড়ির মতোই। তার পর প্রথম শ্রেণিটি প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রমুখদের জন্য তৈরি। বিজনেস ক্লাসটি সহযাত্রী সাংবাদিকদের জন্য। ইকনমি ক্লাসটিতে থাকেন এসপিজি কর্মী ও আন্ডার সেক্রেটারিরা।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে যাচ্ছি সেই রাজীব গাঁধীর সময়। কিন্তু বিমান যাত্রায় যে-সব আয়োজন হয়, তা সে দিনও যেমনটা হত, আজও ঠিক তেমনই। সফর যদি সুদীর্ঘ হয়, যেমনটা হয় মার্কিন যাত্রায় তখন অনেক সময় আকাশপথেই কারও কারও জন্মদিন পালন করা হয়, কেক-টেকও কাটা হয়।
এমনও হয়েছে বিমানের মেঝেতে বসে আমরা সমবেত ভাবে গান গেয়েছি। উই শ্যাল ওভারকাম। সাংবাদিক বা অফিসারদের জন্মদিন শুধু নয়, এই তো কিছু দিন আগের কথা। গত বছর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের জন্মদিনে কেক কাটা হল।
উনি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সকলের মধ্যে এসে খোশগল্প করলেন। একসঙ্গে ছবি তুললেন। করমর্দন করলেন সবার সঙ্গে। তখন ওঁর নিরাপত্তা বাহিনীকে শুধু দেখতে হয়। তাঁদের তখন এক বিচিত্র পরিস্থিতি। উনি আমাদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কথা বলছেন, আর ওঁরা ওঁকে ঘিরে আছেন। ওঁদের উদ্বেগ থেকেই যায়।
এ বারের মার্কিন মুলুক যাত্রার সময় মনমোহন সিংহের জন্মদিন পড়েছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ঠিক সে দিন ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ওয়াশিংটন আসার আগে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই শুনলেন কাশ্মীরে পাক হানার খবর। অনেক ভারতীয় নিহত। সকালবেলা প্রাতরাশ টেবিলে আমরা কালো কফি খেতে খেতে আলোচনা করছিলাম, তা হলে প্রধানমন্ত্রী কি আর তাঁর জন্মদিন বিমানে পালন করবেন!
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ওয়াশিংটন প্রায় সাত-আট ঘণ্টার সফর। ঠিক ছিল কেক কাটা হবে, আর এ বার তো সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী শুধু নন, অধ্যাপিকা কন্যা-জামাতা ও নাতিও ছিলেন। আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রীর আর এক কন্যা থাকেন। কেকটেক অফিসাররা রেডি রেখেছিলেন।
কিন্তু কাশ্মীরের ঘটনা শুনেই প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, যে জন্মদিন পালন যেন কেউ না করেন। অসমের এক মহিলা সাংবাদিক একটা গ্রিটিং কার্ড এনেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তাতে সবাই সই করে ওঁকে শুভেচ্ছা জানানো হল। |
সফর কানুন |
নিরাপত্তা: সফরের আগেই এসপিজি চিফ সংশ্লিষ্ট দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে চলে যান। প্রধানমন্ত্রী কোন হোটেলে থাকবেন, কোন রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করবেন, কোন সভাঘরে ভাষণ দেবেন তা আগে ভাগেই রেকি করে আসেন এসপিজি চিফ। ইন্দিরা গাঁধী হত্যার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তাবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। রাজীব গাঁধীর মৃত্যুর পর স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ বা এসপিজি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রটোকল: প্রটোকলের ভীষণ কড়াকড়ি থাকে। এই ধরনের সফরে প্রধানমন্ত্রীর পরেই থাকেন প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের আত্মীয়রা। তাঁর স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্য। প্রটোকলের বিচারে প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি বা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের স্থান থাকে পরিবারের সদস্যদের পরে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর সফরে দু’ধরনের ডেলিগেশন থাকে। সরকারি ও সহযোগী ডেলিগেশন। এদের জন্য থাকে আলাদা রংয়ের কার্ডের ব্যবস্থাও।
খাবারদাবার: দেশের মতো বিদেশেও খাবার ভাল ভাবে পরীক্ষা করার পরেই তা পরিবেশন করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে। এর জন্য বিশেষ অ্যাডভান্সড ড্রিল করে নিরাপত্তাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর রাঁধুনিও সঙ্গে যান প্রতিটি সফরে।
শোওয়ার ঘর: প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিমানে শোওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। এমনি সময়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমানে শোওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিশেষ শয়নকক্ষের ব্যবস্থা করা হয়। দেখতে লাগে একেবারে বাড়ির মতোই। |
|
বিমান যাত্রার সময় ছোটখাট অঘটনও ঘটেছে। একবার নিউইয়র্ক থেকে ফেরার পথে বিমানে এক সর্বভারতীয় চ্যানেলের বিখ্যাত মহিলা সাংবাদিক অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সাংবাদিকদের মধ্যেই ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি ছুটে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসকও।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চিকিৎসক তো থাকেনই, থাকেন তাঁর ব্যক্তিগত রাঁধুনিও। এমনকী পরিচারকরা। তাঁদের বলা হয় অ্যাটেনড্যান্ট। যেমন, বাজপেয়ীর ছিলেন জয়প্রকাশ। প্রণববাবুর আছে পদম বা হীরাদা (হীরালাল)।
বিদেশে গেলেও নিজস্ব পরিচারক ছাড়া কোনও প্রধানমন্ত্রীই চলতে পারেন না। জয়প্রকাশ বাজপেয়ীর সঙ্গে বহু বছর ছিলেন। তাঁকে সারা বছর দেখা যেত অত্যন্ত সাধারণ বুশ শার্ট আর প্যান্টে। কিন্তু বিদেশ যাত্রার আগে ওঁর জন্য বিশেষ সাফারি সুট তৈরি করে দেওয়া হত। স্বাভাবিক ভাবেই বিমানে সাফারি পরিহিত জয়প্রকাশকে দেখে প্রায় চেনাই যেত না। জয়প্রকাশ বলত, বাজপেয়ী ভিড়ের মধ্যেও ওর দিকে তাকালেই ও নাকি বুঝতে পারত বস্ জল চাইছেন, না ট্যাবলেট!
নরসিংহ রাও-ও বেড়াতে ভালোবাসতেন। তিনি অনেক ভাষাও জানতেন। তাঁর অনায়াস যাতায়াত ছিল অন্তত ১৬টি ভাষায়। বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাঁকে সে-দেশের ভাষায় কথা বলতে দেখেছি! ইন্দিরা গাঁধীর বিদেশমন্ত্রীও ছিলেন। তা ছাড়া এমন একটা সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন যখন আর্থিক উদারবাদের ঝড় ভারতীয় বাজারে এসে আছড়ে পড়েছে। মনমোহন সিংহ তাঁর অর্থমন্ত্রী, মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া তাঁর বিদেশ সচিব। মনমোহনের সঙ্গে প্যারিস যখন গিয়েছি, তখন সেখানে অভিন্ন ইওরোপীয় বাজার ও অভিন্ন মুদ্রা-গঠনের কথাবার্তা শুরু হয়েছে। আজ আমরা যে ইউরো নিয়ে এত আলোচনা করছি, তখন সে ইউরোর জন্মও হয়নি। নরসিংহ রাও ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিবাসে সাংবাদিকদেরও নিয়ে যাওয়া হল।
নরসিংহ রাও হাতে লাল ওয়াইন নিয়ে প্রোটোকল মেনে মধ্যাহ্নভোজন শুরু করলেন। উনিও গ্লাসে চুমুক দিলেন। সাংবাদিকরাও তাই। ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখনও প্রধানমন্ত্রীর ওয়াইন সেবন বা ককটেলে ছাড়পত্র নেই। দেশের ভিতর সরকারি অনুষ্ঠানে এখনও সুরা নয়, ছাড় শুধু শরবতে। কিন্তু তাতে ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদে নরসিংহ রাওয়ের স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও অভাব দেখিনি।
আমাদের টেবিলের সামনে এসে সুসজ্জিত পরিচারকেরা ট্রেতে ধরে আছেন নানা ধরনের খাবারদাবার। এখনও মনে আছে, একটা পদ ছিল বড়সড় সুশীতল মাছ। চোখ খোলা সেদ্ধ মাছ। কাঁটা দিয়ে মাছের অংশ ভক্ষণ করতে হয়। সঙ্গে নানা ধরনের চিজ ও ফরাসি সস। ফারমেন্টেড চিজও ছিল নানা রকম।
এখনও মনে পড়ে, ওই মাছটা দেখে নরসিংহ রাওয়ের চক্ষু একদম ছানাবড়া। কিছুক্ষণ বাদে ধাতস্থ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রসিকতা করে বললেন, বাঙালি মাছ খাব না, এটা কিন্তু বলতে পারবে না। বললাম, আমরা বাঙালিরা তো ঠিক এরকম কাঁচা আর সেদ্ধ মাছ খাই না। কী করে সেই তেলেগু বিড্ডাকে বোঝাই যে বাঙালির সাধের সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ অথবা মৌরলা মাছ ভাজার সঙ্গে এই পদের আসমান জমিন ফারাক!
সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের খানাপিনার সঙ্গে আজকালকার খানাপিনায় অবশ্য অনেকটা ফারাক। তখন দেখতাম বিদেশ গেলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীদের সে দেশের বিশেষ বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হত। তখন প্রথাটা ছিল, ‘হোয়েন ইউ আর ইন রোম, বিহেভ লাইক রোমান’।
এখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রীরা আসার আগে দু’দেশের প্রোটোকল অফিসাররা আলোচনা করে খাওয়াদাওয়ার মেনু ঠিক করেন। এমন নয়, আগে এটা হত না। কিন্তু এখন ‘কালচার শক’টা পুরোপুরি ছেঁটে ফেলাটাই প্রথা। যেমন এ বার হোয়াইট হাউসে ওভাল অফিসে ওবামার সঙ্গে মনমোহন যখন মধ্যাহ্নভোজন করলেন, তখন তাঁর জন্য হোয়াইট হাউসে বিশেষ নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রীতিমতো হাতে গড়া রুটি, ডাল, লাউয়ের তরকারি এসব।
হোয়াইট হাউস কর্তারা বললেন, এর জন্য একজন ভারতীয় রাঁধুনিকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। তিনিই মনমোহন সিংহের জন্য ভারতীয় নিরামিষ খাবার তৈরি করে দিয়েছেন।
মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল হোয়াইট হাউসে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে বিল ক্লিন্টনের বাড়ির ভোজসভা। নৈশভোজ। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ভারতীয় সাংবাদিক ও প্রতিনিধিদের জন্য অ্যাডভাইজরি দেওয়া হয়েছিল যে সকলে কালো কোট আর ট্রাউজার পরে আসবেন। অনেকের কাছেই কালো লাউঞ্জ স্যুট ছিল না। কেউ কেউ তো স্থানীয় লন্ড্রি থেকে ভাড়া করে নিয়ে এলেন। বীর সাংভি আর পঞ্জাব কেশরীর মালিক অশ্বিনী মিন্না ক্লিন্টনের ভোজসভায় যেতে নতুন স্যুট কিনে ফেললেন।
বাজপেয়ীর সঙ্গে ছিলেন জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য, ন্যাশানাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ব্রজেশ মিশ্র। ক্লিন্টন যখন এলেন তখন বাজপেয়ীর পরেই ছিলেন রঞ্জন, তার পর ব্রজেশ। প্রোটোকল অনুসারে প্রথমে পরিবার, তার পর আমলা।
ক্লিন্টন সবাইকে ওঁর বাসভবনের ভিতর নিয়ে গেলেন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে দেখি বিশাল একটা মুখের ছবি। ছবিটি রোনাল্ড রেগনের। সত্যিই রেগনের ছবিটা ওখানে আশাই করিনি। দোতলার ঘরগুলিতেও কাঠের মেঝে। ওখানেই পানীয় দেওয়া হল। দোতলার সেই ব্যালকনি থেকে সোজা তাকালে দেখা যাচ্ছিল শ্বেতশুভ্র লিঙ্কন মেমোরিয়াল। পড়ন্ত রোদ্দুরে দেখা সেই দৃশ্যের স্মৃতি কখনও ভোলার নয়।
বাজপেয়ী বিদেশ যেতে খুব ভালোবাসতেন। বিদেশ গেলে থাকতেনও বেশ কয়েক দিন ধরে। অনেক সময় তো শনি-রবিবারটাও তিনি বিদেশে থাকতে চাইতেন। বিদেশে উইকেন্ড মানে নো-ডিপ্লোমেসি আর সে সময় আমেরিকা গেলে তাঁর আর এক পালিত কন্যা নম্রতা থাকতেন সেখানে। তার সঙ্গে কাটাতেন। আবার জুরিখে গিয়ে বোট ক্রুজ করতেন। আমরাও ঘুরতাম। বাজপেয়ী শপিং করতেও ভালবাসতেন। শপিং-এর সময় সাধারণত তাঁর সঙ্গী হতেন রঞ্জন ভট্টাচার্য।
রাজীব গাঁধী নিজে অবশ্য বিদেশ সফরে গিয়ে কাজেই ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসতেন। এখানে অবশ্য একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, এক একজন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন এক এক রকম আর্থ সামাজিক পটভূমি থেকে।
রাজীব তো লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্য। ছোটবেলা থেকে বিদেশ ঘুরছেন। কিন্তু বাজপেয়ীই বলুন আর দেবগৌড়া - এঁরা উঠেছেন মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তবে রাজীবের সঙ্গে সফরে গিয়ে দেখেছি তিনি খুব ব্ল্যাক চকোলেট খেতেন। সুইস ব্ল্যাক চকোলেট সনিয়া নিজেও খুব ভালোবাসতেন। তাই রাজীব খুব কিনতেনও। সফরের সময় তাঁর প্রিয় ব্যসন ছিল হলিউডের সিনেমা দেখা।
বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সঙ্গে নামিবিয়ার সফরে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মধ্যরাতের স্বাধীনতা দেখতে যাওয়া হল বিশ্বনাথ প্রতাপের সঙ্গে। নানা ধরনের ঝলমলে আলোময় আকাশ। আমরা সবাই এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুরছি। জোরসে ধাক্কা লাগল কারও সঙ্গে। তাকিয়ে দেখি সামরিক পোশাকে স্বয়ং ইয়াসার আরাফাত। সে রাতে ম্যান্ডেলাও ছিলেন সেখানে।
সে যাত্রায় সফরসঙ্গী হিসেবে বিরোধী দলনেতা রাজীব গাঁধীও ছিলেন। উইন্ডহোক শহরে তখন ভিপি আর রাজীব দু’জনেই। গাঁধী পরিবারের সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক এক ইতিহাস, তাই সেদিন রাজীবও আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, ভিপির চেয়েও সে দেশে রাজীবই যেন বেশি জনপ্রিয়। রাজীব ও ভিপি- দুজনেই মঞ্চে। আর ঘোষক বারবার বলছেন, ‘ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার রাজীব গাঁধী আজ আমাদের মধ্যে আছেন।’ এদিকে ভি পি সিংহ মঞ্চে বসে। বেশ কয়েক বার এমন হওয়ার পর রাজীব নিজেই ঘোষককে ভুলটা ঠিক করে নিতে বললেন।
চন্দ্রশেখর বেশি দিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। তার সরকার তো রাজীব গাঁধীর দয়াতেই চলত। তবু তিনিও বিদেশ যাত্রা করে নিয়েছিলেন অল্প সময়ের মধ্যেই।
প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে জওহরলাল নেহরু প্রথম বিদেশ সফরে যান ইংল্যান্ডে। লন্ডনের উদ্দেশ্যে তিনি ভারত থেকে রওনা দিয়েছিলেন ১৯৪৮-এর ৬ অক্টোবর। সেদিক থেকে অক্টোবর মাসটিকেই কি তবে বলা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের উদ্যাপন কাল!
’৪৭ সালের পর কত প্রধানমন্ত্রী এলেন। বিদায়ও নিলেন। তাঁদের সফর তো বটেই, সফরের পোশাক নিয়েও বোধ হয় আস্ত একটা ‘বই’ হয়ে যায়। এক একজন এক এক রাজ্যের, তাঁদের কেউ পরেন ধুতি, কেউ লুঙ্গি, কেউ সাফারি সুট, আবার কেউ বা গলাবন্ধ। নেহরুর পোশাক তো ‘ব্র্যান্ড পোশাক’ হয়ে উঠল। জহর কোট, পকেটে লাল রুমাল। নরসিংহ বিদেশে গিয়েও কোর্টের ওপর শাল রাখতেন। এমনটা কাউকে দেখিনি। রাজীব যেমন চোস্তের সঙ্গে পরতেন স্নিকার।
তবে এ ব্যাপারে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব বোধ হয় ইন্দিরা গাঁধী। অসম্ভব পোশাক সচেতন ছিলেন তিনি। যখন যেখানে যেতেন সেই দেশ-এর পোশাক পরতেন। এ দেশেও যেমন মণিপুর বা শান্তিনিকেতনে তাঁর বেশভূষা থাকত স্থানোপযোগী, তেমনই বিদেশেও।
খুব ভাল ফরাসি এবং রাশিয়ান ভাষাও জানতেন ইন্দিরা গাঁধী। শোনা যায়, একবার নিক্সনের সঙ্গে বৈঠক করে বেরিয়ে খাস ফরাসিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে স্থানীয় মার্কিন এবং সফররত ভারতীয় সাংবাদিকদের বিপাকে ফেলে দিয়েছিলেন! আসলে নিক্সনের সঙ্গে সেই বৈঠকটি আদৌ পছন্দমত হয়নি তাঁর।
সেই ১৯৪৮ থেকে ২০১৩। প্রধানমন্ত্রীর সফরেরও রূপ রস গন্ধ কত বদলে গিয়েছে! কত বিচিত্র ঘটনাও তো জড়িয়ে এই সফর ঘিরে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যেমন। তাসখন্দে গিয়ে মারাই গেলেন!
কিন্তু সফরের মূল সুর আয়োজনে, উদ্যাপনে, বর্ণাঢ্যে বোধ হয় একই রয়ে গিয়েছে। কী বলবেন একে? ‘সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলিতেছে’?! |
ওঁদের পছন্দ |
ইন্দিরা গাঁধী: যে দেশেই যেতেন, বেশির
ভাগ সময়ই পরতেন সেখানকার পোশাক। |
রাজীব গাঁধী: বিমানে কিছু না করুন,
হলিউডের ছবি দেখতেনই। |
|
চন্দ্রশেখর: ফাঁক পেলেই পড়তেন
হিন্দি কবিতার বই। কিংবা লেখালেখি। |
নরসিংহ রাও: লিখে রাখতেন আত্মজীবনীমূলক
উপন্যাস ইনসাইডার-এর কয়েক পাতা। |
|
আই কে গুজরাল: সুযোগ পেলেই আমলাদের সঙ্গে
বিদেশনীতি নিয়ে আড্ডা দেওয়াটা ছিল ওঁর স্বভাবে। |
অটল বিহারী বাজপেয়ী: মেয়েজামাইয়ের সঙ্গে
আড্ডা
দিতে পছন্দ করতেন। শপিং-এও যেতেন। |
|
|
মনমোহন সিংহ: মোটা একটি বই নিয়ে বিমানে ওঠেন।
মূলত অর্থনীতি সংক্রান্ত। ফেরার সময় সেটি শেষ হয়ে যায়। |
|
|
|
|
|
|
|