|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা ১... |
|
ব্যাপক বিনোদন, সফল মঞ্চায়ন |
তবু নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির জীবনের যথার্থ প্রতিরূপ কি? লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। |
নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির জীবন ও কাজ নিয়ে ‘ইন্দ্ররঙ্গ’র উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাট্য প্রযোজনা ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যায়ন ও পরিচালনায়। একজন কীর্তিমান পুরুষের শেষ জীবনের সঙ্কট ও নিঃসঙ্গতা নাটকের বিষয় বলে, এবং সেই জীবনের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য, ঘটনা ও অভিঘাতের সমাহারে গড়া বলে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ ‘ট্যাবলো’র পরম্পরায় উন্মোচিত ব্রেশটের ‘গালিলিও’-কে মনে করায়। মাহাত্ম্য বা গভীরতা নয়, করণকৌশলের জন্য।
বিশেষ করে দেবেশ যখন বলেইছেন তাঁর ‘নির্দেশকের কথা’-য় যে, ‘আমি প্রকৃত অর্থে নাট্যকার নই, সে জন্য নাট্যরূপ করার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছবি এসেছে আগে, কথা জুড়েছে তারপরে।’ ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’-এ পরের পর, পরের পর অজস্র ছবি আছে। নায়কের জীবনে ওঠা-পড়া, সাফল্য ও ব্যর্থতা, সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ বিচ্ছিন্ন সব দৃশ্যে ও পরিস্থিতিতে তুলে ধরা হয়েছে। সবটাই বাঁধার চেষ্টা হয়েছে শিশিরবাবুর নিজের স্মৃতিচারণা ও জবানবন্দিতে। এই স্মৃতিচারণা প্রায় সরব স্বগতোক্তির ধারায় বলা মঞ্চস্থ ঘটনাবলির ধারাবিবরণীর কাজ করে।
একজন নাট্যব্যক্তিত্ব নিয়ে করা বলে এই নির্মাণে নাটকের মধ্যে নাটক, মঞ্চের মঞ্চ, চরিত্রের মধ্যে জীবন এবং জীবনের মধ্যে চরিত্র এসে পড়েছে। দৃশ্যের মধ্যে দৃশ্যের মধ্যে দৃশ্য... অ্যাপিয়ারেন্স ও রিয়্যালিটির একটা আন্দোলন। |
|
শিশিরবাবরু মঞ্চস্থ করা নাটকের থেকে ছ-ছ’টিকে প্রয়োগ করা হয়েছে নাটকের মধ্যে নাটক হিসেবে। শেষটি হল গিরিশচন্দ্রের ‘প্রফুল্ল’, যার বিধ্বস্ত, পরাস্ত চরিত্রযোগেশের সংলাপেই যেন শিশিরকুমারও নিজের জীবনের ওপর শেষ মন্তব্য করে দেন ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’।
যোগেশের এই সংলাপ বলে শিশিরকুমার অন্তরালে গেলে তিনি যথার্থ ট্র্যাজিক নায়ক হন না। আরেকটি যোগেশ হন মাত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জার্নালে পাচ্ছি ১৯৫৬-য় শ্রীরঙ্গম নাট্যশালা থেকে বিদায়ের দিন তাঁর প্রশ্ন, ‘থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল?’-র উত্তরে নাট্যাচার্য দৃপ্ত ভঙ্গিতে জানাচ্ছেন, ‘থিয়েটার বন্ধ হবে না। এ বাড়ি শুধু আমাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে।’ নতুন বাড়ি তিনি খুঁজে পাননি, নতুন নাটকও হয়নি, তাতে তাঁর ট্র্যাজিক মহিমা কমেনি বই বেড়েইছে।
শিশিরকুমারের স্মৃতিচারণায় তাঁর স্ত্রী ঊষার বিলাপ ও আত্মহত্যা আসে। যে-প্রভা দেবীকে সে কালের এক সেরা অভিনেত্রীতে গড়ে নিয়েছিলেন, তাঁর অনুনয়, অনুযোগ, নিরাপত্তাহীনতাও আসে। আসে পরিণত বয়সে যে-শিক্ষিতা তরুণীর আকর্ষণে পড়েছিলেন সেই কঙ্কাবতীর প্রণয় ও বিচ্ছেদ। আসে বাণিজ্যিক নাট্যপ্রযোজকদের সঙ্গে কাজের সুযোগ ও বিপন্নতার অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে আসে ‘আলমগীর’ নাটকের নায়কের সঙ্গে নিজের পরিস্থিতির করুণ সাদৃশ্যের ছবি। আসে নাটকের টানে ইংরেজির অধ্যাপনা, ত্যাগ। আসে নাটকের জন্য স্বপ্ন দেখা, আসে সাফল্যে ঈর্ষা ও প্রতিরোধ কুড়োনো, ব্যর্থতায় উত্তরোত্তর একলা হয়ে পড়া। এই সব স্মৃতিই অভিনয়ে অভিনয়ে ছবির মতো প্রক্ষেপ করার উদ্যোগ নিয়েছেন পরিচালক।
শুধু ছবির মতো প্রক্ষেপণ বললে আংশিক বলা হবে, কারণ কী কারণে জানি না, শিশিরবাবুর জীবনটাকে দেবেশ গানে গানে, নাচে নাচে প্রায় মিউজিক্যালধর্মী (না কি সিনেমাধর্মী?) করে ফেলেছেন। যতই রবীন্দ্রমুগ্ধ হন শিশিরকুমার, সারাটা জীবন এ ভাবে প্লেব্যাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর পিছু না নিলে তিনি মেজাজ হারাতেন। তুলনায় তাঁর কবিতা বলা এক নতুন মাত্রা জোড়ে নাটকে। চোখা জলও আনে।
আসলে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ বড্ড বেশি নির্ভরশীল শুধু একটি মাত্র চরিত্র ও সেই চিরত্রের অভিনয়ের ওপর। অর্থাৎ শিশিরকুমার চরিত্র ও দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয়ের ওপর।
দেবশঙ্করের কণ্ঠবাদন, অভিব্যক্তি, শরীরের ভঙ্গি, দীর্ঘাতিদীর্ঘ সংলাপ সমান উচ্ছাসে কিংবা সংযমে বলার ক্ষমতা, মঞ্চক্ষেত্রকে ব্যবহারের দক্ষতা, প্রয়োজনে যখন-তখন নতুন নতুন ইমোশনে চলে যাওয়া ক্রমাগত মুগ্ধ করে আসছে দর্শককে। এ নাটকেও সাধাকণ দর্শক, যাঁদের ৯৯ শতাংশ শিশিরকুমারের অভিনয় দেখেননি, অভিভূত না হয়ে পারবেন না। কণ্ঠধ্বনি, প্রভা বা কঙ্কার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আবেগের মোচড়, আলমগীরের অভিনয় বা শিশিরকুমারের স্মৃতিচারণা তাঁদের আবিষ্ট করবে। কিন্তু যাঁরা শিশিরকুমারকে দেখেছেন, জেনেছেন, তাঁর সম্পর্কে অজস্র রচনার কিছু না কিছু পড়েছেন।
তাঁদের মনে হবে নাটক, সংলাপ এবং কিছুটা অভিনয়ের কারণে শিশিরকুমারের রাশভারী, সংযত, অন্তর্মুখীন সত্তাটি এখানে অবহেলিত। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করার সেরা মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হয়তো আরও কেউ কেউ। আমি শুধু স্মরণ করব ১৯৫৫ সালের এক সন্ধ্যা রংমহল থিয়েটারে, যে দিন বাবা ও কাকার সঙ্গে শিশিরবাবুর এক শেষ ‘প্রফুল্ল’ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাল্যের সেই সন্ধ্যা আজও ভুলিনি কারণ আশেপাশের সব মানুষকে এ ভাবে কাঁদতে আর কখনও দেখিনি।
এও মনে আছে কীভাবে ভিখারির অনুকরণে যোগেশ ‘দু’টো পয়সা’ চাইছেন আর অবসন্ন ধ্বনিতে মন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছেন ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’। যেন নিজের অজ্ঞাতেই। সে দিন জানতাম না এই যোগেশ করছেন শিশিরকুমার বলে কেউ।
দেবশঙ্করের আসল প্রচিযোগিতা হয়তো এই সব স্মৃতির সঙ্গে। শিশিরবাবুর প্রতিযোগিতা যেমন হয়তো, ছিল গিরিশস্মৃতির সঙ্গে। এইটা যে বলা গেল এ-ই হয়তো দেবশঙ্করের সেরা প্রশংসা।
প্রভা ও কঙ্কাবতীর ভূমিকায় সুন্দর অভিনয় দেখলাম, কারা করলেন জানাতে পারছি না কারণ ব্রোশিওরে চরিত্রানুগ ভাবে অভিনেত্রীর উল্লেখ নেই। সম্মেলক নাচ ও গানগুলো চোখ ও কানের পক্ষে সুখকর, যদিও নাটকের পক্ষে নয়। মঞ্চভাবনায় অভিনবত্ব আছে, মঞ্চসজ্জা ও আলোর ব্যবহার তুখোড়। তবে মঞ্চে নানা চরিত্রের থেকে থেকে ওয়াকার (walker) ব্যবহারের কী কারণ বোঝা গেল না।
শিশিরবাবু তাঁর স্মৃতি বা জবানবন্দি শোনানোর সময় যখন ব্যবহার করেন তখন তা খুবই সুপ্রযুক্ত। কারণ ওয়াকার তখন মঞ্চের মধ্যে এক ভাষণবেদি হয়ে ওঠে। প্রভারও কি তার প্রয়োজন হয়? তিনি তো সংলাপ বলছেন অন্য চরিত্রকে।
শেষে এটুকুই বলব যে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ বহুল ব্যয়ে এক ব্যাপক বিনোদন। দোষেগুণে এক সফল মঞ্চায়ন। বাঙালি দর্শক এর পৃষ্ঠপোষকতা করলে নাটকের মঙ্গল। |
|
|
|
|
|