রবীন্দ্রনাথের গানের একটি পরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট একটি বিষয় বিন্যাসের প্রয়োজন যে কতটা জরুরি তারই উপলব্ধি হল নতুন ভাবে রবীন্দ্রসদনে। উৎসাহ উদ্ভাস আয়োজিত রাহুল মিত্রের ‘কাঁদায়ে গেলে’ শীর্ষক একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে যেমন মৃত্যু একটা বড় বিষয়, তেমনি প্রেমও। মৃত্যু এবং প্রেমের কথা এত করে বলেছেন কবি তাতেই মিলনে বিচ্ছেদে বেদনায় রচিত হয়েছে জীবনসঙ্গীত। আর সেই রচনার একমাত্র সাক্ষী তাঁর জীবনদেবতা। কবি-প্রয়াণের চিরবেদনা ভরে ছিল এ দিনের গানে।
অনুষ্ঠান যথারীতি দু’টি পর্বেই সাজানো ছিল। নির্বাচন ও গানের ক্রম গল্প ও ছবি একসঙ্গে রচনা করেছিল। প্রথম পর্বের গানে শেষ বিদায়ের অভিমান। দ্বিতীয় পর্বের গান ‘যে চলে গেছে ফিরে’ তাঁর অভিমান মুছে ফিরিয়ে আনে, গানে গানে। এ এক অভাবনীয় কথোপকথন যেন। সাধুবাদ জানাতেই হয়, এই মনন নিবেদনের জন্য। বিষয়বস্তুর প্রতি সন্নিষ্ঠ থেকেই গীতবিতানের স্বদেশ পর্যায় ব্যতিরেকে প্রায় সব ক’টি পর্যায় থেকে সুর ও তাল বৈচিত্রের দিকে লক্ষ রেখে দু’টি পর্বে মোট ৩৬টি গান নির্বাচন করেছিলেন। রাহুলের কণ্ঠ গভীর, উদার ও মধুর। বহুচর্চিত। তাঁর গায়কী সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি গানকে সযত্নে তালে লয়ে আলাদা করে নিতে তিনি সুদক্ষ।
তাঁর অনুষ্ঠানের একটা বিশেষ আভিজাত্যও আছে। গান নির্বাচন থেকে শুরু করে সহযোগী যন্ত্রশিল্পী নির্বাচন সব কিছুই স্বাভাবিক সুন্দর। প্রকৃত শিল্পীসত্তাই যার উৎস। গানগুলির নির্বাচন দেখলেই বোঝা যায় এ একটা পূর্ণতার বোধ। ‘আমার যাবার সময় হল’ দিয়ে শুরু করে ক্রমে ক্রমে এল ‘আমার যাবার বেলায়’, ‘আমার আর হবে না দেরি’, ‘ওরে মাঝি’ প্রভৃতি। রক্তকরবীর গান ‘চোখের জলের লাগল জোয়ার’ একটি অসাধারণ নিবেদন। মন্দ্র সপ্তকের নিষাদ থেকে তার সপ্তকের ঋষভ পর্যন্ত কোথাও অতিরিক্ত চড়া বা খাদ নেই। কাফি বাঁরোয়া ও মিঞামল্লার মিলে এই গানের যে বিষাদময়তা সেই ভাবটিই রাহুল অত্যন্ত যত্নসহকারে ফোটালেন। আবার ‘খেলার সাথী’ বা প্রায় অশ্রুত গীতবিতানের পরিশিষ্ট ৬ সংখ্যক গান ‘আঁধার সকলি’র রূপকল্পে সমগ্র অনুষ্ঠানের মূল সুরটি ধ্বনিত হল তাই নয়, গানগুলির বিষাদময়তা শ্রোতার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদের প্রায় একাত্ম করে নিলেন। এই গানগুলিতে অম্লান হালদারের বেহালায় সহযোগিতা একেবারে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। |