বাঁচতে হবে। তাই বদলাতে হবে। এক দিকে চিনে আলোর দাপট। অন্য দিকে এলইডি। যুগ যুগ ধরে দীপাবলির রাত আলোর মালা পরেছে যে মাটির প্রদীপ দিয়ে, তার তাই অস্তিত্বেরই সঙ্কট। তাই নতুন ধরনের মাটির প্রদীপ তৈরি করে বাজার ধরার চেষ্টায় অনেকটাই সফল কয়েকজন কারিগর। শঙ্খ, মাছ, কচ্ছপ, লন্ঠন বা পদ্মফুলের মতো সেই সব প্রদীপ পড়তে না পড়তে
বিকিয়ে যাচ্ছে।
|
কিন্তু কান্দি শহর ঘেঁষা যশহরি আনোখা দু’নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার দোহালিয়া গ্রামের পালপাড়ায় মাটির প্রদীপ বিক্রি তলানিতে। এখন একটা সময় পুজোর পর থেকে মাটির প্রদীপ তৈরির কাজে মেতে থাকতেন শিল্পীরা। এখন সেখানে হাতেগোণা কয়েকজন ছাড়া বাকি শিল্পীরা শুধু প্রদীপ নয়, মাটির কাজই বন্ধ করে অন্য কাজের সন্ধান করছেন। কেউ চাষের কাজ করছেন, কেউ বা কাজের খোঁজে ভিন্ রাজ্যেও পাড়ি দিয়েছেন।
তবে এই নিরাশায় থমকে না থেকে এই অবস্থার মধ্যেই নতুন পথের সন্ধান পেয়েছেন কয়েকজন শিল্পী। চিনে আলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে নতুন ভাবে সাজছে মাটির প্রদীপ। শিল্পীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়, রঙে রূপে সে সব প্রদীপ যেন এক একটি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ঘন রঙের উপর সেই সব প্রদীপ দেখতে ভাল। তেলও চলকে পরবে না। বরং স্নিগ্ধ মায়াবী আলোয় হেসে উঠবে মাটির প্রদীপখানি কিংবা পদ্মফুল, হাতের তালু, শঙ্খ বা গণেশের মত নানা আকৃতির এক একটি প্রদীপ যেন এক এক টুকরো আলোকিত ভালো লাগা হয়ে উঠবে। ছোটোবড় নানা ধরনের অসংখ্য কলকার নকশা শিল্পীর হাতের গুণে হয়ে উঠেছে দিয়া। শুধু কি তাই? ধানের গোলা, হ্যারিকেনের অবয়বের ঢাকা দেওয়া প্রদীপদান— চমকের যেন শেষ নেই। কান্দির পালপাড়ার শিল্পীরা জানান, প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ি আলোকিত করতে প্রথমত ৮০ টাকায় একশো প্রদীপ কেনার পর তাতে প্রায় এক কেজি সরষের তেল লাগবে। আধুনিক আলোর খরচ সে তুলনায় কম। তাই প্রদীপের চাহিদা কমছে। কিন্তু নবদ্বীপে যে নানা ধরনের মাটির প্রদীপ মিলেছে, তা দামে বেশ সস্তা। মাত্র ২ টাকা থেকে শুরু হয়ে বড়জোর ৭০ বা ৮০ টাকা। নিবু নিবু মাটির প্রদীপশিখাকে আবার উজ্জ্বল করে তুলতে ময়দানে নেমেছেন যে জনা কয়েক কারিগর ও শিল্পী, তাঁদের অন্যতম চিরদীপ নিয়োগী। হাওড়ার পঞ্চানন তলার বাসিন্দা যুবক চিরদীপের কথায়, “নতুন ধরনের কাজ করতে আমার চিরকালই ভালো লাগে। দীপাবলির রাতে প্রদীপ বা মোমবাতির আগের কদর নেই। সবাই মেতেছে ভিনদেশী আলোর মোহে সেই থেকে এই উদ্যোগ বলতে পারেন।
চিরদীপবাবু জানান, তাঁর শ্যালক জগন্নাথ ধাড়াকে সঙ্গে নিয়ে গত বছর থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে ডিজাইনার মাটির প্রদীপ তৈরী শুরু করেন। জগন্নাথবাবু বলেন, “বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা আগে কাঁচামাটির প্রদীপ তৈরী করাই। তারপর পোড়ানো হয়। সব শেষে রঙের কাজ।” আর এই কাজেই বাজিমাত করে দিয়েছেন তাঁরা। লাল, সবুজ,নীল আর খয়েরি রঙা জমির উপর নজরকাড়া সব ডিজাইন বাজারে পড়তে না পড়তে বিক্রি হয়ে যাছে। আর বাজার হিসাবে ওরা আপাতত বেছে নিয়েছেন হুগলি ও নদিয়ার কয়েকটি জায়গা। কিন্তু এই জায়গাগুলিই কেন? চিরদীপবাবুর কথায়, “নবদ্বীপ, মায়াপুরে নানা জায়গার মানুষ আসেন। তাই মুখে মুখে প্রচার হবে খুব তাড়াতাড়ি। আর হচ্ছেও তাই। চাহিদা এতো বেশি যে, আমরা দিয়ে উঠতে পারছি না। অর্থবল বা লোকবল আমাদের খুব কম যদি আর্থিক ভাবে একটু সাহায্য পাই, তাহলে চিনে বাতির জৌলুসকে প্রদীপ দিয়েই ম্লান করা সম্ভব।”
কিন্তু কী কারণে পালপাড়ার শিল্পীরা পেশা ছাড়ছেন? মঙ্গলবার সকালে কান্দির দোহালিয়ার পালপাড়ায় অতুল পাল, মধুসূদন পালদের মতো শিল্পীদের কথায়, “সারা বছরই মিষ্টির দোকানে মিষ্টি দেওয়ার জন্য মাটির তৈরি হাঁড়ির কাজ হত। চা ও জলের ভাঁড় তৈরির কাজ লেগেই থাকত। তার উপর দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজো পর্যন্ত মাটির তৈরি প্রদীপের জোগান দিতে হিমশিম খেতে হত। কিন্তু এখন মিষ্টির হাঁড়ি থেকে প্রদীপ—কোনও কিছুরই আর তেমন চাহিদা নেই।” শিল্পীদের দাবি, পালপাড়াতে প্রায় কুড়িটি পরিবার মাটির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বর্তমানে সেটা ঠেকেছে আটটি পরিবারে। এক মহিলা শিল্পী রাধারানি পাল বলেন, “ওই কাজ করেই সংসার চালিয়েছি। ছেলেমেয়ে বড় করেছি। কিন্তু বছর তিনেক হল আর তেমন বাজার নেই। বাধ্য হয়েই কাজ ছেড়েছি।” |