পাগড়িটা বাঁ হাতে সামলে নিজের মনেই বিড় বিড় করেন, “খুলে না যায়।”
আগাগোড়া লাল কার্পেট মোড়া মঞ্চ। ‘দাদা এই মাত্র মঞ্চে উঠে পড়লেন...’ পুজোর ম্যাড়াপের আনাচ কানাচ থেকে রীতিমতো হুঙ্কার ছাড়ছে ধারাভাষ্য। ‘মেটালের’ চড়া হলুদ আলোয় থেকে থেকে বদলে যাচ্ছে তাঁর আকাশ-নীল ফুল হাতা জামার রং। ডান হাতের ঝকঝকে তলোয়ারটা নতমুখ নামিয়ে অস্ফূটে তিনি বলেই ফেলেন, “দেখিস বাবা, খোঁচা না লাগে!”
গত দেড় দশক ধরে হাতের তালুর মতো চেনা বহরমপুরে এ বার তাঁকে আদালতের অনুকম্পায় পা রাখতে হয়েছে। পুর ভোটের প্রাক্কালে অস্ত্রের ‘খোঁচা’ আর চাইছেন অধীর চৌধুরী। খাস তালুকে নবাবি উষ্ণীষটাও কি এ বার খুলে রাখতে হবে?
দেওয়াল ও রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো শাসক দলের পুর প্রচার, এ বার সে হাওয়াই তুলে দিয়েছে। যা দেখে, মাস পয়লা শুরু করা তাঁর প্রথম কর্মী সভা শেষে অধীর বলছেন, “বহরমপুরের মানুষকে ওরা চেনেই না। দেখবেন, এ শহরে এ বারও তৃণমূল তৃতীয় শক্তি মাত্র।” বলছেন বটে, কিন্তু তিনিও জানেন, যুদ্ধটা এ বার ‘অন্যরকম’। অধীর ঘনিষ্ঠ জেলা তৃণমূলের এক তাবড় নেতাই জানাচ্ছেন, বহরমপুরে গত দু-দু’টি পুর-নির্বাচনে বিরোধী শূন্য ভাবে জয়ী কংগ্রেসের একটি আসনও শাসকদলের দখলে যাওয়া মানে ‘দাদা’র ‘মুখ পোড়া’। |
মাস কয়েক আগে, রেজিনগরে উপ-নির্বাচনে প্রাক্তন মন্ত্রী তথা একদা তাঁর প্রিয় শিষ্য হুমায়ুন কবীরকে হেলায় হারিয়েছে কংগ্রেস। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও কংগ্রেসের সাফল্যের ধারা যে তাঁর সুবাদেই অক্ষুণ্ণ, দলের হাইকমান্ড মেনে নিয়েছে তা-ও। রেল প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে অধীরকে শুধু পুরস্কৃত করাই নয়, তৃণমূলকে পাল্টা চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছে দিল্লি। কিন্তু মাস খানেক আগে খুনের ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ায় গত চল্লিশ দিন নিজের খাস তালুকেই পা রাখতে পারেননি তিনি। আপাতত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী জামিন পেয়েছেন তিনি। এ বার তাই দলকে নিরঙ্কুশ বহরমপুর জয় দিতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হচ্ছে তাঁকে।
টানা তিন বারের বিরোধী শূন্য বহরপুর পুরসভায় এ বার ৩ নম্বর এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ড দু’টি কংগ্রেসের পক্ষে ‘টাফ সিট’। সবুজ সংঘের মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে এ দিন বহরমপুর পুরভোটের প্রথম কর্মী সভায় ৩ থেকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় কর্মীদের কাছে তিনি শুনলেন গত পাঁচ বছরে বহরমপুর পুরসভার কাছ থেকে নাগরিকদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান। তারপর জবাব দিলেন। তাহলে? অধীরের কথায় অবশ্য, “লড়াই কঠিন না হলে মজা কোথায়?”
৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের প্রার্থী কানাই রায় দলের বহরমপুর মহকুমা সভাপতিও বটে। অধীর চৌধুরির ‘বদান্যতায়’ তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বহরমপুর পুরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। প্রাক্তন অধীর অনুগামী প্রদীপ নন্দীও এ বার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের প্রার্থী। তিনি বর্তমানে তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সহ-সভাপতি। তিনিও ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর বহরমপুর পুরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। তার মধ্যে এক বার তিনি উপ-পুরপ্রধানও ছিলেন। তাঁর ‘কোর গ্রুপ’-এর একদা ওই দুই কাণ্ডারির সঙ্গে অধীর চৌধুরির আদায়-কাঁচকলায় সর্ম্পক শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে। ফলে প্রাক্তন দুই ‘শিষ্য’-র সঙ্গে এবার ‘গুরু’-র লড়াই। ‘টাফ সিট’ বলেই ‘দাদা’ সেখান থেকেই ভোটের প্রচার শুরু করলেন বলে কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের দাবি। বহরমপুর টাউন কংগ্রেস সভাপতি অতীশ সিংহ বলেন, “নবগ্রাম বিধানসভা ছিল সি পি এমের ভিয়েতনাম। দাদা সেখান থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু মিথ্যা খুনের মামলায় ফেরার থাকায় ভোটের প্রচারে যেতে পারেননি। তাঁর ক্যাসেট শুনে মানুষ তাঁকে জিতিয়েছিলেন। ওই টাফ সিটে জেতার আড়াই বছর পর তিনি বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে ভোটে লড়ে জিতেছেন। ওই আসনে তার আগে মাত্র এক বারই কংগ্রেস প্রার্থী জিতেছিলেন, তাও ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুর অব্যাহতি পরে সহানুভূতির ভোটে। আসলে অধীরদা বরাবর টাফ সিটে লড়তে চান।”
কানাই রায় দাবি করেন, “২ নম্বর, ৩ নম্বর, ৪ নম্বর এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ড এ বার নিশ্চিত ভাবেই তৃণমূলের দখলে যাচ্ছে।” সেই ওয়াার্ডগুলি থেকেই এ দিনের সভায় পুরপরিষেবা নিয়ে অধীর চৌধুরিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্ন করা হয়, “জল নিকাশির জন্য শ্বেতা খাঁর পুকুর সংস্কার করা হবে বলে ৫ বছর আগে বলা হয়েছিল। কিন্তু আজও প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি কেন? বহরমপুর পুরসভা গঙ্গার ধারের বস্তিগুলি উচ্ছেদ করবে বলে শুনছি, কপিলের মাঠ পুরসভা দখল করবে বলে প্রচার চলছে। আসলে ঘটনাটি কি?”
জবাবে অধীর বলেন, “শ্বেতা খাঁর পুকুর পুরসভার নয়। ওটি ব্যক্তি মালিকানার। সংস্কার করা জন্য বিশাল আয়তনের ওই পুকুরটি মালিকের কাছ কিনে নেওয়ার জন পুরসভার পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল। আজ যাঁরা তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন তাঁরাই কলকাঠি নেড়ে পুরসভাকে পুকুরটি নিতে দেয়নি। তাই সংস্কার করা যায়নি।” কোনও মাঠ পুরসভা দখল করবে না, বরং স্কোয়ার ফিল্ড এবং ওয়াই এম এ মাঠের মতো সৌন্দর্যায়ন করবে। এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুরভোট এলেই পুরসভার বিরুদ্ধে বিরোধীরা বস্তি উচ্ছেদের মিথ্যা অপপ্রচার চালায়। গঙ্গার ধার বরাবর যে বস্তিগুলি রয়েছে রাজ্য সরকারের ভূমি দফতর ও বন দফতরের মালিকানায়। ওই জমি পুরসভার নয়, ফলে পুরসভার পক্ষে উচ্ছেদ করার প্রশ্নই ওঠে না। ওই সব জমির মালিকানা পুরসভা পেলে বস্তিবাসীর জন্য ‘স্লাম ফ্রি ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে বহুতল আবাসন করে দেওয়া হবে।”
|
অধীরের সেই বক্তৃতার সিডি পেল কমিশন
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পুরভোটের প্রচারে বহরমপুরে এসে দলীয় কর্মিসভা শেষে শুক্রবার অধীর চৌধুরী
জানিয়ে দিলেন,
বহরমপুরে এ বারও নিরঙ্কুশ প্রাধান্য নিয়ে ফিরছে কংগ্রেস। দিনান্তে বেশ
কয়েকটি সর্বজনীন কালীপুজোর উদ্বোধনও করলেন তিনি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক |
পুর নির্বাচনের প্রচারে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর বিতর্কিত বক্তৃতার সিডি রাজ্য নির্বাচন কমিশনে পৌঁছেছে। ২৭ অক্টোবর প্রদেশ কংগ্রেসের ‘বহরমপুর চলো’ কর্মসূচিতে অধীরবাবুর বক্তৃতায় নির্বাচন বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ। সেই বক্তৃতার একটি সিডি পাঠানোর জন্য মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছিল কমিশন। শুক্রবার এক কমিশন-কর্তা জানান, জেলাশাসক সিডি-র সঙ্গে একটি রিপোর্টও পাঠিয়েছেন। দু’টিই খতিয়ে দেখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খুব শীঘ্র জেলাশাসককে নির্দেশ দেওয়া হবে। অধীরবাবুর বক্তৃতার সিডি তিন দিনের মধ্যে কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছেন মুর্শিদাবাদের ডিএম। কিন্তু জুলাইয়ে পঞ্চায়েত ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বক্তৃতার সিডি পায়নি কমিশন। অনুব্রতবাবুর বিরুদ্ধেও বিতর্কিত বক্তৃতায় নির্বাচন বিধিভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল। পাড়ুই থানার কসবা বাসস্ট্যান্ডে দলীয় প্রচার সভায় ওই বক্তৃতা দেন তিনি। তা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। বীরভূমের জেলাশাসকের কাছে সেই বক্তৃতার সিডি চেয়েছে কমিশন। কিন্তু ওই জেলাশাসকের কাছ থেকে এখনও কোনও সিডি বা লিখিত রিপোর্ট আসেনি বলে কমিশনের এক মুখপাত্র এ দিন জানান। |