|
|
|
|
বর্গি হানায় ঠাঁইনাড়া দেবীর ভোগে আজও কাঁচা আনাজ
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। ঘোর অমানিশার রাত। ফরিদপুরের বান্ধব-দৌলতপুর গ্রামে কালীপুজোর আয়োজনে ব্যস্ত রামগতি সেনগুপ্তের পরিবার। জনশ্রুতি, সে বার পুজোর জোগাড় চলাকালীন বর্গিরা হামলা চালায়। কোনও মতে নমো নমো করে পুজো সাঙ্গ করতে হয়। তাই ভোগ রাঁধা আর হয়ে ওঠেনি। সে দিন অন্নভোগের পরিবর্তে দেবীকে নিবেদন করা হয়েছিল কাঁচা শাকসব্জি, চাল, ডাল ও মশলাপাতি। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবায় সেনগুপ্ত পরিবারের পুজোয় আজও ভোগ হিসেবে কাঁচা আনাজ নিবেদন করা হয়।
ফরিদপুরের মাদারিপুর এলাকার বান্ধব-দৌলতপুর গ্রামে ছিল সেনগুপ্তদের আদি ভদ্রাসন। ঐতিহ্যের পুজোর বয়স তিনশো পেরিয়েছে। তবে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে গৃহকর্তা পেশায় প্রখ্যাত কবিরাজ রামগতি সেনগুপ্তর আমলেই ফরিদপুরের পুজোয় জৌলুস বাড়ে। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে টানা দশ বছর বর্গিরা বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ চালিয়ে আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। সেই আতঙ্কের রেশ পৌঁছেছিল পূর্ববঙ্গেও। বর্গিদের আতঙ্কে বার বার ঠাঁইনাড়া হন সেনগুপ্ত-পরিবার। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে রামগতি সেনগুপ্তর উত্তরসূরিরা পূর্ববঙ্গ থেকে ঝাড়গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবায় সেনগুপ্ত পরিবারের আবাসস্থল ‘রজনীকুটির’। পূর্ববঙ্গের বসতবাটি ছেড়ে এলেও ঐতিহ্যের পুজো ছাড়তে পারেননি সেনগুপ্তরা। ১৯৪৮ সাল থেকে ঝাড়গ্রামের বাড়িতে সেনগুপ্তদের পারিবারিক দুর্গা ও কালীপুজো শুরু হয়। সেনগুপ্ত পরিবারের প্রবীণ সদস্য মনোজ সেনগুপ্ত, অজয় সেনগুপ্ত, সুব্রত সেনগুপ্ত-রা বলেন, “এক সময় লাগাতার বর্গি হামলার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা আত্মগোপন করে পুজোর আয়োজন করতেন বলে শুনেছি। ওই অবস্থায় ভোগ রাঁধার সুযোগ হতো না। ভোগ হিসেবে কাঁচা আনাজ নিবেদন করা হত। সেই প্রথা এখনও চলে আসছে।”
কাঁচা আনাজের পাশাপাশি দেবীকে ফলমূল, খই, মুড়কি ও নারকেল নাড়ুর নৈবেদ্য দেওয়া হয়। মহানিশার পুজোয় আগে ছাগবলি দেওয়া হত। পরিবারের প্রবীণা আলো সেনগুপ্ত বলেন, “পূর্ববঙ্গের পুজোয় বলির পর শেয়াল আসত। আড়াই দশক আগেও ঝাড়গ্রামে বলিদানের পর পুজো মণ্ডপের সামনে শেয়াল আসতে দেখেছি। ১৯৯২ সাল থেকে বলি বন্ধ করে দেওয়া হয়।” সেনগুপ্ত পরিবারের তরুণ প্রজন্মের সদস্য দীপঙ্কর সেনগুপ্ত বলেন, “বাড়ির বেশির ভাগ সদস্যই কলকাতা কিংবা বাইরে থাকেন। আমিও কলকাতায় থাকি। তবে দুর্গা পুজো ও কালীপুজোয় সবাই এখানে চলে আসি। ক’টা দিন হইচই করে কেটে যায়।”
ফরিদপুরের পুজোর সময় যাত্রা, কবিগান ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসত। আতসবাজির রোশনাই নজর কাড়ত আশেপাশের বহু গ্রামের মানুষের। সেই দিন আর নেই। আড়ম্বর গিয়েছে, তবে ঐতিহ্য আর আন্তরিকতা আজও অম্লান রয়েছে সেনগুপ্ত বাড়ির পুজোয়। |
|
|
|
|
|