কয়েক বছর আগেও শব্দটার সঙ্গে বিশেষ পরিচিতি ছিল না বাঙালির। কিন্তু নিত্য পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার সুবাদে আজ বাঙালিও ভীষণ ভাবে সামিল ধনতেরাসের উৎসবে। বিশেষত, দুর্গাপুর বা আসানসোলের মত শিল্পাঞ্চলে যেখানে সাংস্কৃতিক যাতায়াত চলে সব সময়।
উত্তর ভারতে দীপাবলি মূলত পাঁচ দিনের। তার প্রথম দিন ধনতেরাস বা ধন ত্রয়োদশী। বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসবের সূচনা হলেও এখন তাতে সামিল সারা দেশ। এই দিনই ঘর-বাড়ি রঙ করে, আলো দিয়ে সাজিয়ে, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন এঁকে ধনলক্ষ্মীর আরাধনা করেন অবাঙালিরা। সৌভাগ্যের জন্য কেনা হয় সোনা, রূপো বা অন্য কোনও মূল্যবান ধাতুর এক টুকরো অলঙ্কার। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ন্যূনতম একটি বাসনও কেনা চলে। এটাই প্রথা।
এক পৌরাণিক গল্পেও ধনতেরসের সূচনার কথা পাওয়া যায়। শোনা যায়, অনেককাল আগে হিম নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ১৬ বছরের পুত্রের ভাগ্যে ছিল যে বিয়ের চতুর্থ দিনে সাপের ছোবলে মৃত্যু হবে তাঁর। কিন্তু সে রাতে নববধূ রাজকুমারকে জাগিয়ে রাখতে এক পরিকল্পনা করেন। শয়নকক্ষের প্রবেশ পথে প্রচুর সোনার গয়না ও সোনা রূপোর মুদ্রা স্তুপ করে রাখেন। প্রদীপের আলোয় ভরিয়ে দেন সারা প্রাসাদ। সারা রাত গান করে, গল্প শুনিয়ে রাজকুমারকে জাগিয়ে রাখেন তিনি। পরে মাঝরাতে সাপ সেজে আসেন স্বয়ং যমরাজ। কিন্তু গয়নার উপর এত আলো পড়ে চোখে ধাঁধা লেগে যায় তাঁর। রাতভর গয়নার স্তুপে বসে নববধূর গান শুনতে থাকেন যম। অপেক্ষায় সকাল হয়ে যায়। নিঃশব্দে ফিরে আসেন তিনি। সোনা গয়নার সাহায্যে রাজকুমারকে বাঁচিয়ে আনার এই দিনই ধনতেরস বলে প্রচলিত। |
দুর্গাপুরের একটি অলঙ্কার বিপনীতে ক্রেতাদের ভিড়।—নিজস্ব চিত্র। |
তখন থেকেই বোধহয় এই উৎসবের সঙ্গে গয়না কেনার রেওয়াজ চলে আসছে। এই মরসুম জুড়ে এমনিতেই বিকিকিনির হিড়িক থাকে। তার সঙ্গে ধনতেরাস জুড়ে যাওয়ায় বিক্রিবাটা বাড়ে সোনারূপোর দোকানেও। গয়নার দামে বা মজুরিতে নানারকম ছাড় দিয়ে ক্রেতা টানেন ব্যবসায়ীরাও। বিয়ের মরসুমের গয়নাও অনেকে কিনে রাখেন এখন।
শুক্রবার প্রায় সারাদিনই ভিড় দেখা গেল দুর্গাপুরের সাবেক গয়নার দোকান বা হালফিলের ব্র্যান্ডেড দোকানে। সিটি সেন্টারের একটি দোকানে দেখা গেল ভিড় সামলাতে বাইরেও একাধিক কাউন্টার খোলা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তাকর্মীও। ওই দোকানের এক কর্মী জানালেন, গত বছর রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান খোলা রেখেও সব ক্রেতাকে পরিষেবা দেওয়া যায়নি। সন্ধ্যার পর থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করে বলে তাঁর দাবি। একই হাল বেনাচিতির এক পুরনো গয়নার দোকানেও। দোকান মালিক চন্দন দাস বলেন, “বছর পাঁচেক ধরে দেখছি, অবাঙালিদের সঙ্গে বাঙালিরাও পাল্লা দিয়ে মেতে উঠেছে এই উৎসবে।” বর্ধমান শহরের বিসি রোড ও জিটি রোডের দোকানগুলিতেও একই ছবি। ভিড়ের মধ্যেই পছন্দসই ডিজাইন খুঁজে নিচ্ছেন ক্রেতারা। ধনতেরাসের সঙ্গেই ভিড় জমেছে দীপাবলির বাজারেও। রকমারি প্রদীপ, এলইডি আলো, মোমবাতি কিনতে লাইন। আবার বাজির দোকানে ভিড় কচিকাঁচা থেকে বড়দের। দুর্গাপুরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, “অবাঙালি বন্ধুদের ধনতেরাসের গল্প শুনে বাবা-মাকে আলো দিয়ে বাড়ি সাজাতে বা গয়না কিনতে বাধ্য করছে অনেক খুদেই।” সিটি সেন্টারের নন-কোম্পানি এলাকার রাজকুমার বক্সীও বলেন, “যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আর কি! আগে দুর্গাপুজোর পরে কালীপুজো ছিল। এখন মাঝে যোগ হয়েছে ধনতেরাস।” |