|
|
|
|
সম্ভ্রান্ত বিত্তবান ছিলেন সাকেত, চতুর্থ শতকে
অলখ মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
সাকেত নামে এক ‘বিত্তবান’ ব্যক্তি ছিলেন। চতুর্থ শতকে তাঁর বাস ছিল এখন জঙ্গল ঘেরা সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমার গোবর্ধনপুর, সুরেন্দ্রগঞ্জ এলাকায়। পুরাতত্ত্ববিদদের অনুমান, তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ এক জনপদেরই নাগরিক।
ওই এলাকা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির একটি সিলমোহর থেকে পাওয়া গিয়েছে সেই তথ্য। প্রাচীন লিপি ও মুদ্রা বিশেষজ্ঞ সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “ওই সিলমোহরটি সাকেত বলে কোনও এক ব্যক্তির। তিনি বিত্তবান বা অবস্থাপন্ন কোনও ব্যক্তি ছিলেন, তা না হলে তাঁর নামে সিলমোহর হত না। তিনি বণিকও হতে পারেন। যে লিপিতে তাঁর নাম লেখা হয়েছে, তা পূর্ব ভারতীয় চতুর্থ শতকের ব্রাহ্মী। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের শেষ থেকে চতুর্থ শতকের গোড়ার মধ্যে এই সিলমোহরটি তৈরি বলে অনুমান।” |
|
|
সমতটের স্বর্ণমুদ্রা। লিপিটি
আনুমানিক চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের। |
ওই মুদ্রারই গৌণ বা উল্টো
পিঠ। উৎকীর্ণ দেবী প্রতিমা। |
|
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা এই এলাকায় সমৃদ্ধ জনপদ অবশ্য ছিল সেই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেই। সম্প্রতি ওই এলাকা থেকে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে মনে করা হচ্ছে, হাজার বছর আগেও ওই এলাকায় ছিল রীতিমতো সভ্য সমাজ। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “ওই এলাকায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে টানা পাল যুগ পর্যন্ত জনবসতির পরিচয় মিলেছে। এখানে প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র থাকতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।” পুরাতত্ত্ববিদদের ধারণা, এই জনপদের সঙ্গে সমুদ্র পথে আরাকান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ভারত উপকুলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। নদীপথে সম্পর্ক ছিল উত্তর-মধ্য ভারতের শহরগুলির সঙ্গে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় ওই এলাকায় ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন। তাঁর কথায়, “আদি ও মধ্য যুগে এই এলাকা যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সম্ভবত বন্দরনগরীও ছিল এখানে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরেই বহির্বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যব্যবস্থার সঙ্গে এই জনপদের যে সরাসরি সম্পর্ক ছিল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। সমুদ্র উপকুলবর্তী এই বাণিজ্যকেন্দ্রর সঙ্গেও তাম্রলিপ্ত বন্দরের সম্পর্ক নিশ্চয়ই ছিল।” |
|
|
পোড়ামাটির এই সিলমোহরে
উৎকীর্ণ ‘সাকেত’-এর নাম। |
বৃষবাহন মুদ্রাটি ষষ্ঠ শতকে
শশাঙ্কের সমসাময়িক। |
|
পুরাতত্ত্ববিদদের অনুমান, সে কারণেই এই এলাকা থেকে মিলেছে বেশ কয়েকটি মুদ্রাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক সুস্মিতা বসুমজুমদারের কথায়, “তির ধনুক হাতে দণ্ডায়মান রাজার একটি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। স অক্ষরটি লেখা রয়েছে এক পাশে। মুদ্রাটির গৌণ বা উল্টো দিকে রয়েছেন এক দেবী।” তাঁর কথায়, মুদ্রাটি সমতটের। তার এক দিক গুপ্ত ঐতিহ্য অনুসারী, অন্য দিকটি কুষাণ ঐতিহ্য অনুসারী। পরে অবশ্য মুদ্রাটি কণ্ঠভূষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর কথায়, “এই মুদ্রাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে বর্তমান দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের সঙ্গে সুন্দরবনের এই এলাকাটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল।” তিনি জানান, এখান থেকে পাওয়া বৃষবাহনের মূর্তিটি শশাঙ্কের সমসাময়িক। এই এলাকা থেকে কষ্টিপাথরের যে ভাঙা বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, অনুমান করা হয় সেই পাথর এসেছিল রাজমহল থেকে নদীপথে। এখান থেকে পাওয়া গিয়েছে ঘরকন্নার কাজে লাগে এমন অনেক তৈজসপত্র। পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান, এখানে একটি নাগরিক সমাজেরই অস্তিত্ব ছিল।
কিন্তু এই এলাকা থেকে সেই জনপদ পরে সরে গেল কেন? গোটা এলাকাই জঙ্গলে ভরে গিয়েছিল মধ্য যুগে। ভূবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি দফতরের প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী ভূতত্ত্ববিদ পার্থসারথি চক্রবর্তী বলেন, “সমুদ্রের ধার ঘেঁষা এই ধরনের নিচু এলাকায় যে কোনও সময়েই সুনামি এবং নানা ধরনের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনপদ বিপন্ন হতে পারে। এখন বিভিন্ন জায়গায় মাটি খুঁড়তে গেলে দশ থেকে পনেরো ফুট তলা থেকেও গাছের গুঁড়ি পাওয়া যাচ্ছে। তার অর্থ হল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সমুদ্রের জলের সঙ্গে আসা বালির একটা মোটা আস্তরণ এই এলাকার উপরে পড়ে গিয়েছিল। তাই তার নীচে ঢাকা পড়ে থাকতে পারে জনপদও। এখন মাটির ক্ষয়ের ফলে তার কিছু কিছু উপরেও উঠে আসছে।”
সেই রকমই কিছু পুরাকীর্তি পেয়ে তা যত্ন করে সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বজিৎ সাহু ও বিমল সাহু। সেই সঙ্গে সম্প্রতি নিবিড় অনুসন্ধান করেছে রাজ্য প্রত্ন দফতরও। অমলবাবু বলেন, “ওই এলাকায় আরও অনেক প্রত্নস্থল রয়েছে। যা এখনও উৎখনন করা হয়নি। সেই উৎখননের পরেই এলাকার চরিত্র পরিষ্কার বোঝা যাবে।”
|
ছবি শিহরণ নন্দীর সৌজন্যে। |
|
|
|
|
|