মুখের কথায় কাজ নয়
নেতার নিয়ন্ত্রণ বন্ধে কবচ সুপ্রিম কোর্টের
বশেষে আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক প্রভুদের চাপমুক্ত করতে বড় ধরনের সুরক্ষাকবচ দিল সর্বোচ্চ আদালত।
এক সুদূরপ্রভাবী রায়ে সুপ্রিম কোর্ট আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, নেতা তথা রাজনৈতিক প্রভুদের মৌখিক নির্দেশ মানতে আর বাধ্য নন আমলারা। তাঁরা চাইলে সেই মৌখিক নির্দেশ ফাইলে লিখে রাখতে পারেন, যাতে কোনও অনিয়ম বা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ভবিষ্যতে তাঁদের বিপদে পড়তে না হয়। আমলাতন্ত্রের হাত শক্ত করতে আরও একটি অমোঘ দাওয়াই দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের বক্তব্য, কোনও পদে কোনও আমলা কত দিন থাকবেন, সেই মেয়াদ নির্দিষ্ট করতে হবে। নেতাদের খামখেয়ালে ঘনঘন বদলি করা চলবে না কোনও আমলাকেই।
রাজনৈতিক প্রভুদের হাত থেকে আমলাতন্ত্রকে বাঁচানোর স্বার্থে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব টিএসআর সুব্রহ্মণ্যন-সহ ৮৩ জন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। সেই মামলার রায়ে বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই নির্দেশ দেয়।
সাত বছর আগে প্রকাশ সিংহ মামলায় পদস্থ পুলিশকর্তাদের ক্ষেত্রেও কোনও পদে মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। আজ আমলাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে গিয়ে শীর্ষ আদালত এই সংক্রান্ত প্রশাসনিক সংস্কারের পক্ষেও জোরালো সওয়াল করল। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলেই অবনতি হচ্ছে আমলাদের কাজের। তা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু কী ভাবে তা বন্ধ করা সম্ভব? শীর্ষ আদালতের দাওয়াই, সংসদে এই সংক্রান্ত একটি আইন পাশ করা উচিত, যাতে সেই আইনের সাহায্যে আমলাদের বদলি, পদোন্নতি ঠিক করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ঘনঘন বদলি আটকাতে এই আইন বড় পদক্ষেপ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ, কোনও পদে আমলাদের ন্যূনতম সুনির্দিষ্ট মেয়াদ স্থির করে তিন মাসের মধ্যে তা জানাতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলিকে।

এই প্রসঙ্গে রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি পি সি ঘোষ বলেন, আমলাদের মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করলে তা শুধু তাঁদের পেশাদারিত্ব ও কর্মদক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে না, সুশাসন কায়েম করতেও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।
সুপ্রিম কোর্টে এই রায়ে স্বাভাবিক ভাবেই আজ স্বস্তির হাওয়া আমলাতন্ত্রের অন্দরমহলে। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে আমলাদের কী পরিণতি হতে পারে, হালফিলে তার একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমলাদের একাংশের অভিযোগ, সনিয়া গাঁধীর জামাই রবার্ট বঢরার বিরুদ্ধে জমি কেলেঙ্কারি নিয়ে সরব হওয়ার কারণেই হরিয়ানা সরকারের ভূমি রাজস্ব দফতরের আইএএস অফিসার অশোক খেমকাকে প্রথমে বদলি করা হয়। এখন সাসপেন্ড করার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। একই ভাবে উত্তরপ্রদেশের আইএএস অফিসার দুর্গাশক্তি নাগপালকে সাসপেন্ড করার স্মৃতিও এখন আমলামহলে তাজা। এমন উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গেও বিরল নয় বলেও ওই আমলাদের মত।
কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক আমলার বক্তব্য, রাজনৈতিক প্রভুদের সিদ্ধান্তের কারণে তাঁদের ভবিষ্যৎ কতটা অনিশ্চিত হতে পারে, সেই অশনিসঙ্কেত তাঁরা পেয়েছেন টুজি কাণ্ডে এবং কয়লা খনি বণ্টনের ঘটনায়। সেখানে টেলিকম লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্তা তথা মন্ত্রীরা। তদন্তে প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী আন্দিমুথু রাজার জেল হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে জেলে যেতে হয়েছে মন্ত্রকের তৎকালীন সচিব ও অন্য কর্তাদেরও। একই ভাবে কয়লা খনি বণ্টনের ঘটনায় সম্প্রতি প্রাক্তন কয়লা সচিব পি সি পারেখের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে সিবিআই। অথচ আমলামহলে পারেখ সৎ অফিসার বলেই পরিচিত। তাঁর নিষ্ঠা ও সততার পক্ষে সওয়াল করেছেন প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব থেকে শুরু করে তাবড় আমলারা। এই দুই ঘটনার পরে কোনও ফাইলে সই করার ব্যাপারে রীতিমতো ভীতির সঞ্চার হয়েছে আমলাদের মধ্যে। ইউপিএ সরকারের নীতিপঙ্গুত্বের পিছনে সেটাও একটি বড় কারণ বলে মনে করেন অনেকেই। বিষয়টি আঁচ করে আমলাদের মনোবল বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও বহুবার বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায় ঘোষণার পর সামগ্রিক ভাবে আমলারা মনে বল পেয়েছেন। প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার টিএসআর কৃষ্ণমূর্তি আজ বলেন, “আমলাদের বদলি ও পদোন্নতি হল রাজনৈতিক প্রভুদের হাতে বড় অস্ত্র। কোনও আমলাকে পুরস্কার বা শাস্তি দিতে তা ব্যবহার করা হয়।” এ দিনের রায়ের ফলে কি অবস্থা বদলাবে? এই নিয়ে কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে প্রকারান্তরে একমত পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন আমলাদের একাংশ। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন যেমন এই রায়কে স্বাগত জানিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন, “অতীতে পুলিশের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ আদালত একই ধরনের রায় দিয়েছিল। পুলিশের বদলি তো যেমন চলার তেমনই চলছে।” প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ও বলেছেন, “পুলিশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কী হাল হয়েছে, আমরা দেখেছি।” আর এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব অশোকমোহন চক্রবর্তী অবশ্য আশাবাদী। তিনি বলেন, “এই রায় কেন্দ্র ও রাজ্যকে মানতেই হবে। যদি কোনও সরকার তা মানতে না চায়, তা হলে আবার সর্বোচ্চ আদালতে যেতে পারে। কিন্তু এখন মানতেই হবে।” কেন্দ্রের আর এক প্রাক্তন আমলা কমল তাওড়িও বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট ঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছে। আমলাদের সৎ ও সঠিক পথে থাকার একটাই উপায়। তা হল, সব কিছু লিখে রাখুন ফাইলে।”
আমলাতন্ত্রের ওপর নেতারা অনৈতিক ভাবে ছড়ি ঘোরান— এই অভিযোগ নতুন নয়। সে দিক থেকে দু’পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে। কেন্দ্রের এক শীর্ষ মন্ত্রী আজ বলেন, “তালি কি এক হাতে বাজে? এর জন্য দু’হাত প্রয়োজন।” তাঁর কথায়, “অতীতে এমন কিছু ঘটনার কথাও জানি, যেখানে রাজনৈতিক প্রভুদের অনিয়ম আর দুর্নীতি করার পথ বাতলে দিয়েছেন আমলারাই। কারণ, মন্ত্রীদের থেকে আইন এবং আইনের ফাঁক সম্পর্কে তাঁরা বেশি ওয়াকিবহাল। আবার রাজনৈতিক প্রভুরা চটে যাবেন, এমন আশঙ্কায় অনেক ক্ষেত্রেই আমলারা মুখে রা কাটেন না। ‘ইয়েস মিনিস্টার’ হয়ে চাকরি জীবন কাটিয়ে দেন।” এ কথা বোঝাতে গিয়ে ওই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি জানান, পটেল একদা বলেছিলেন, আজ আমার সচিবদের জানিয়েছি, কোনও বিষয়ে সৎ পরামর্শ দিতে কুণ্ঠা বোধ করবেন না। সেই পরামর্শ আমার মতের বিরুদ্ধে যাবে বলে যদি ভয় পান, তা হলে আপনি অন্যত্র কাজ খুঁজে নিন। আমি অন্য সচিব খুঁজে নেব।
সম্প্রতি আইএএস অফিসারদের একটি নতুন ব্যাচের সামনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, “আমলাদের অনেক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক চাপে নিতে হয় এমন ধারণা এখনও রয়েছে। তবে আমলাদেরও উচিত রাজনৈতিক কর্তাদের যথাযথ পরামর্শ দেওয়া। কোনও নির্দেশ পালন করা সম্ভব না হলে তা-ও ব্যাখ্যা করে জানানো উচিত।” সামনেই লোকসভা ভোট। এই সময়ে আরও একটা ভয় পাচ্ছেন আমলারা। তা হল, জমানা যদি বদলায় তবে বর্তমান অফিসারদের অনেককেই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরানো হতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক নয়, কারণ অতীতে বহুবার এমন ঘটেছে। আমলাদের কেউ কেউ অটলবিহারী বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত সহায়ক তথা আইএএস অফিসার শক্তি সিনহার উদাহরণ দেখাচ্ছেন। ক্ষমতায় থাকার শেষ দিকে বাজপেয়ী তাঁকে বিশ্বব্যাঙ্কে ভারতীয় প্রতিনিধির সচিব হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেই প্রথমে শক্তি সিনহাকে কাবুলে, পরে আন্দামানে পাঠিয়ে দেয় মুখ্যসচিব করে। পরে দিল্লি ক্যাডারের ওই অফিসারকে শীলা দীক্ষিত সরকার বিদ্যুৎসচিব হিসেবে নিয়োগ করে। সে সময় তাঁকে প্রচুর হেনস্থা সহ্য করতে হয় বলে অভিযোগ। একসময় তাঁকে রাতারাতি অর্থ দফতরে বদলি করে দেওয়া হয়। তিনি সম্প্রতি স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.