|
|
|
|
রেশন দোকানে ঝাঁপ, কর্তাকে সামনে পেয়ে সরব গ্রামবাসী
কেদারনাথ ভট্টাচার্য • পূর্বস্থলী |
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। দুটি সাদা গাড়িতে প্রায় নিঝুম এক ঝিলের পাড়ে এসে পৌঁছলেন প্রশাসনের জনাকয়েক আধিকারিক। গাড়ি থেকে নেমেই টর্চ হাতে কয়েকজন পূর্বস্থলীর বড় কোবলা গ্রামের কয়েকজনকে জোগাড় করে ফেললেন বিডিও তপনকুমার মণ্ডল। জানালেন, সঙ্গে অতিরিক্ত জেলাশাসক রয়েছেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন তিনি।
কাছাকাছি কোবলা চাঁপাহাটি মৎস্যজীবী সমিতির কার্যালয়ে দ্রুত তাঁদের বসার ব্যবস্থা করলেন বাসিন্দারা। মাঠ, ঘাট থেকে ফিরে অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। বিডিও গ্রামবাসীদের অনুরোধ করলেন বাড়ি বাড়ি খবরটা পৌঁছে দিতে। মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়ে শুরু হল সভা। সন্ধ্যা যত গড়াল ততই ভিড় বাড়তে লাগল বাসিন্দাদের। উঠে এল একের পর এক প্রশ্ন।
প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের সমস্যা জানতে, তাঁদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতির মান বাড়াতে ধারাবাহিক ভাবেই সরকারি আমলাদের বিভিন্ন গ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্ধমান জেলা প্রশাসন। জেলাশাসকের নির্দেশ কাজ শুরু করেছেন অতিরিক্ত জেলাশাসকেরা। কারণ বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক গণ্ডগোল না হলে সচরাচর প্রশাসনের আধিকারিকদের গ্রামে দেখা যায়না। গ্রামবাসীরাই নানা সমস্যা নিয়ে আসেন। তবে গত ১৯ অগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বর্ধমানে এসে জেলাশাসক, মহকুমাশাসক, বিডিও ও অন্যান্য আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানেই আধিকারিকদের গ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ২৬ সেপ্টেম্বর জেলার উন্নয়নমূলক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রথমে জেলা পর্যায়ের আধিকারিকেরা, পরে এসডিও, বিডিও ও ব্লক পর্যায়ের আধিকারিকেরা গ্রামে যাবেন। সেখানেই রাত কাটাবেন তাঁরা। অচেনা পরিবেশে মুশকিল আসানের জন্য মশার ধূপ, শুকনো খাবার নিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়। দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয় ৬ জন অতিরিক্ত জেলাশাসককে। কালনার দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) প্রণব বিশ্বাস। |
|
বড় কোবলা গ্রামে গ্রামবাসীদের সঙ্গে চলছে বৈঠক। —নিজস্ব চিত্র। |
বুধবার দুপুরে পূর্বস্থলী ১ ব্লক অফিসে বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও পঞ্চায়েত সদস্যদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) প্রণববাবু। ওখান থেকেই সন্ধ্যা নাগাদ রওনা দেন গ্রাম সফরে। গ্রামে পৌঁছে সভার শুরুতে মোট লোকসংখ্যা, তাঁদের পেশা, সরকারি স্কুল, হাসপাতাল, অঙ্গনওয়ানি কেন্দ্র কত দূরে, আশা কর্মীরা গ্রামে আসেন কিনা, মিড-ডে মিল ঠিকঠাক মেলে কি না, প্রসূতীরা সরকারি সুবিধা কেমন পাচ্ছেন, রেশন পরিষেবা মিলছে কি না এ সমস্ত জানতে চান প্রণববাবু। তাঁর কথায় ভরসা পেয়ে গ্রামবাসীরাও একে একে সমস্যার কথা জানাতে শুরু করেন। মহিলারা জানান, রেশন দোকান মাত্র তিন দিন খোলা থাকে। এডিএম জানান, দোকান সাড়ে পাঁচ দিন খোলার নিয়ম। ওই এলাকার রেশন ডিলার মহাদেব বিশ্বাসকে ডেকেও পাঠান তিনি। মহাদেববাবু মিনমিন করে বলেন, “স্যার, সব দিন লোক হয়না।” তাতে মৃদু ধমক দিয়ে এডিএম বলেন, “সেটা আপনার দেখার বিষয় নয়, সপ্তাহে চার দিন অন্তত দোকান খোলা রাখুন।” এরপরেই স্থানীয় মৃদুলা মণ্ডল জানান, তিনি বিধবা, বিপিএল কার্ডও রয়েছে। কিন্তু সরকারি কোনও পেনশন পান না। আরও কয়েকজনও একই দাবি তোলেন। প্রশ্ন শুনে আশ্চর্য এডিএম সঙ্গেসঙ্গে ফোন করেন এক আধিকারিককে। গ্রামবাসীদের আশ্বাস দেন, এমন হওয়ার কথা নয়, বিডিওকে কী করতে হবে তাঁর নির্দেশও দেন। শান্তি মণ্ডল বলেন, “আমার বিপিএল কার্ড রয়েছে, অথচ মোটা অঙ্কের ইলেকট্রিক বিল আসে।” প্রশ্ন শেষ হতেই ফোন বিদ্যুৎ দফতরের স্টেশন ম্যানেজারকে। শান্তিদেবীকে বললেন, “বাড়িতে একটা আলো জ্বালালে বিল মেটাতে হবে না। কিন্তু তার বেশি আলো জ্বললে টাকা দিতে হবে।” রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন বাড়তে থাকে। কখনও নদী বাঁধ, কখনও অন্ত্যোদয় যোজনা, আসের্নিক মুক্ত পানীয় জল নিয়ে সমস্যার কথা জানান গ্রামবাসীরা। কিছু সমস্যা ফোনেই মিটল, কিছু মেটাতে বিডিও ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে নির্দেশ দিলেন তিনি।
৯টা বাজতেই দেখা গেল কেউ মন দিয়ে শুনছেন, কেউ আবার ঘুমে ঢুলে পড়ছেন। পাতলা হতে লাগল ভিড়। কিন্তু এ বার টর্চ হাতে গ্রামের ভিতরে এগিয়ে গেলেন এডিএম। কারও বন্ধ বাড়ির কড়া নেড়ে, কাউকে আধো ঘুম থেকে তুলে জানতে চাইলেন, সব ঠিক আছে কিনা। এডিএমের হাঁক শুনে টালির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন অলকা মণ্ডল। বললেন, “স্বামী নেই, তাঁত বুনে ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে সংসার চলে। কিন্তু বিপিএল কার্ড পাইনি।” এডিএম তাঁকে জানালেন, বাড়িতে কার্ড করাতে একটি দল আসবে। তাঁদের নিজের পরিস্থিতির কথা জানাতে।
রাত ১১টা নাগাদ গ্রামবাসীদের অনুরোধে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেরার পথ ধরলেন এডিএম। প্রণববাবু বললেন, “নির্দেশ রয়েছে যতটা পারি ঘটনাস্থলেই সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার। মাসে অন্তত একটি করে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।” |
|
|
|
|
|