সরাসরি ছোবল তো সে দিচ্ছেই। উপরন্তু কিডনি, লিভারে ডেরা বেঁধে ক্যানসারের মতো মারণ রোগও ডেকে আনছে। এ বার কালাজ্বরে মৃত্যুর পিছনেও সেই আর্সেনিকের ভূমিকাকেই দায়ী করলেন এক দল গবেষক। তাঁদের দাবি, আর্সেনিক দূষণের বাড়বাড়ন্ত কালাজ্বর নিরাময়ের বহুল প্রচলিত ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিচ্ছে।
বিহারে কালাজ্বরে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি সেখানে সমীক্ষা চালিয়েছেন স্কটল্যান্ডের এক দল গবেষক। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, কীসের জন্য সে তল্লাটে রোগটি ওষুধ-প্রতিরোধী (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) হয়ে উঠছে। সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের শরীরে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। এবং সেটাই ওখানে কালাজ্বরে মৃত্যু-মিছিলের মূল কারণ বলে তাঁদের দাবি। মার্কিন জার্নাল ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস (পিএনএএস)’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে সমীক্ষকেরা বলেছেন, নলকূপের পানীয় জলের মাধ্যমে ওখানকার মানুষ আর্সেনিক-দূষণের কবলে পড়েছেন।
এ প্রসঙ্গেই আর্সেনিকের সঙ্গে কালাজ্বরে মৃত্যুর সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করেছেন স্কটল্যান্ডের ডান্ডি ও অ্যাবেরডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তাঁদের বক্তব্য: শরীরে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি যে লিভার, কিডনি ও যকৃৎ ক্যানসারের অন্যতম কারণ, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। অজৈব আর্সেনিক সরাসরি দেহের বিপাক-ক্রিয়ায় প্রভাব ঘটিয়ে এই সব অঙ্গে কোষের মৃত্যু ঘটায়। পরিণামে অঙ্গগুলি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। “এখন দেখা যাচ্ছে, কালাজ্বরের চিকিৎসায় সব চেয়ে জনপ্রিয় যে ওষুধটি, শরীরে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি তাকেও নিষ্ক্রিয় করে দেয়।” বলেছেন সমীক্ষকদের দলের প্রধান অ্যালান ফেয়ারল্যাম্ব। ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিজ্ঞানীর মতে, বিহারে কালাজ্বরের মারণবিস্তারে আর্সেনিকেরই অবদান সর্বাধিক।
আর্সেনিক কী ভাবে কালাজ্বরের ওষুধ অকেজো করে দিচ্ছে? |
পিএনএএসের নিবন্ধে গবেষকদের ব্যাখ্যা, ওষুধটির মধ্যে অ্যান্টিমনি নামে একটি মৌল রয়েছে। রাসায়নিক ধর্মের বিচারে তার সঙ্গে আর্সেনিকের বিস্তর মিল। যার দরুণ ওষুধটি কোষে ঢোকার পরে তার অ্যান্টিমনির জায়গায় ঢুকে পড়েছে আর্সেনিক। ফলে ওষুধের চরিত্র বদলে যাচ্ছে। তা কোষের মধ্যে বসে থাকা কালাজ্বরের জীবাণু লিসম্যানিয়াকে নিকেশ করতে পারছে না। ফলে পরজীবীটির অপ্রতিহত সংক্রমণে খাদ্যনালি-লিভার-কিডনির কোষ দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ মৃত্যু। গবেষকেরা জানান, ইঁদুরের উপরে পরীক্ষায় তত্ত্বটি প্রমাণিত হয়েছে।
গত বারো বছরে বিবিধ সমীক্ষায় বিহারের ১৭টি জেলায় ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। তার দশটিই কালাজ্বরপ্রবণ। এ-ও দেখা গিয়েছে, ওই দশ জেলায় কালাজ্বর-আক্রান্তদের শরীরে অ্যান্টিমনিযুক্ত ওষুধ কাজ করছে না। এই তথ্যের উল্লেখ করে গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিহারে ব্যর্থ হলেও বিশ্বের আর যে সব জায়গায় কালাজ্বরের প্রকোপ (প্রায় তামাম আফ্রিকা, ব্রাজিল ইত্যাদি), সেখানে অ্যান্টিমনিযুক্ত ওষুধ কিন্তু দ্রুত রোগ সারিয়ে ফেলছে। আবার বিহারে অন্য ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে ভাল ফল মিলছে, যার দাম তুলনায় বেশি। অথচ সেখানে অ্যান্টিমনিযুক্ত ওষুধ কেন কালাজ্বর ঠেকাতে পারছে না, ডাক্তারেরা তা ভেবে পাচ্ছেন না।
এ বার তাঁদের গবেষণা চিকিৎসকমহলের বিভ্রান্তি দূর করবে বলে স্কটল্যান্ডের সমীক্ষকদলের দাবি। তাঁদের আশা, কালাজ্বরের চিকিৎসা সম্পর্কে নতুন পরিকল্পনা রচনাতেও এখন স্বাস্থ্য-কর্তারা দিশা পাবেন। অ্যাবেরডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান জো ফেল্ডম্যানের কথায়, “আর্সেনিক নানা ভাবে শরীরের ক্ষতি করে। আমাদের সমীক্ষায় তার আর একটা ক্ষতিকর দিক ধরা পড়ল।”
এই উদ্যোগের সঙ্গে কলকাতার নামও জুড়ে গিয়েছে। স্কটল্যান্ডের গবেষকদলটির অন্যতম সদস্য জন মেঘান বিহারে সমীক্ষা চালানোর সময় কাজ করেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধিকর্তা (গবেষণা) দীপঙ্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে। দীপঙ্করবাবু অবশ্য বলছেন, “অ্যান্টিমনিযুক্ত ওষুধের কার্যকারিতায় আর্সেনিক দূষণের প্রভাব নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ হচ্ছে। কিন্তু সম্পর্কটা কী, তা এখনও পরিষ্কার হয়নি।” এবং পিএনএএস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রেও তিনি খুব একটা আশার আলো এখনই দেখতে পাচ্ছেন না। “মেঘান ও তাঁর সহযোগীরা ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা করে একটা প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের উপরে পরীক্ষা হলে আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ইঁদুরের দেহে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, মানুষের দেহে তেমনটা না-ই ঘটতে পারে।” মন্তব্য দীপঙ্করবাবুর।
দীপঙ্করবাবুর মতো আরও কেউ কেউ স্কটল্যান্ডের সমীক্ষকদের দাবির সঙ্গে এই মুহূর্তে একমত হতে পারছেন না। যেমন কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। ট্রপিক্যালে টানা কুড়ি বছর যে গবেষণাগারের দায়িত্ব তিনি সামলেছেন, সেটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কালাজ্বরের ‘রেফারেল ল্যাবরেটরি’র মর্যাদা দিয়েছিল। অমিতাভবাবু মনে করছেন, আর্সেনিক যদি সত্যিই কালাজ্বরের অ্যান্টিমনিযুক্ত ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে থাকে, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক আক্রান্ত চার জেলা মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও দুই ২৪ পরগনাতেও সেটি কাজ করত না। অথচ কালাজ্বরপ্রবণ ওই সব জায়গায় কম মাত্রার অ্যান্টিমনিযুক্ত ওষুধ প্রয়োগে ভাল ফল মিলেছে, দাবি অমিতাভবাবুর।
তা হলে বিহারের সমীক্ষাটির তাৎপর্য কতটা?
অমিতাভবাবু বলেন, “এত সমীক্ষক যখন আর্সেনিকের সঙ্গে কালাজ্বরের ওষুধের নিষ্ক্রিয়তার একটা সম্পর্ক পেয়েছেন, তখন নিশ্চয়ই তার কোনও একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। তবে সম্পর্কটা এত সরল নয়। দেখতে হবে, কেন বিহারের বেলায় আর্সেনিক কালাজ্বরের ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, অথচ পশ্চিমবঙ্গে পারছে না।” |