মধ্যমগ্রামের কিশোরীকে যে গণধর্ষণ করা হয়েছে, তার প্রমাণ মিলল ডাক্তারি পরীক্ষায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার ধর্ষণ প্রসঙ্গে টালবাহানা করায় প্রশ্নের মুখে জেলা পুলিশ।
শুক্রবার রাতে প্রথম বার গণধর্ষণের পরে রবিবার পুলিশ ওই কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছিল। অভিযোগ, সে দিনই রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ১৪ বছরের ওই কিশোরীকে তুলে নিয়ে আবার ধর্ষণ করে প্রধান অভিযুক্ত। রাতে বাড়ি ফেরার সময় কিশোরীকে কেন পুলিশ-পাহারা দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে এ দিন দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এলাকার মানুষ ও বিরোধী দলগুলি। দ্বিতীয় বার ধর্ষণের পরেও সেই মামলা কেন নথিভুক্ত করা হল না, কেন ফের ওই কিশোরীর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হল না তা নিয়েও পুলিশের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে নির্যাতিতার পরিবার।
পুলিশের এই ভূমিকা খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। নির্দেশে বলা হয়েছে, কোনও একজন উচ্চ পদস্থ পুলিশ অফিসারকে দিয়ে ওই ঘটনার তদন্ত করে দু’সপ্তাহের মধ্যে কমিশনে রিপোর্ট জমা দিতে হবে।
পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার গভীর রাতেই ঘটনার মূল অভিযুক্ত ছোট্টু ওরফে সঞ্জীব তালুকদার ও পলাশ দেবনাথ নামে আর এক যুবককে বিড়া ও এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার সকালে তাদের বারাসত আদালতে তোলা হয়েছে। তাদের ১২ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। এখনও অধরা আরও পাঁচ অভিযুক্ত। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, প্রায় মাসখানেক ধরে পরিকল্পনা করেই দলবল নিয়ে ছোট্টু ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে।
শুক্রবার রাতে ঘটনার পরে শনিবার সকালে মধ্যমগ্রাম থানায় গণধর্ষণের অভিযোগ জানিয়েছিল কিশোরীর পরিবার। রবিবার বারাসত হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয় কিশোরীর। ওই দিন রাতেই মধ্যমগ্রাম থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ফের ধর্ষণের অভিযোগ তোলে কিশোরী ও তার পরিবার। তাদের অভিযোগ, থানায় এফআইআর করার প্রতিশোধ নিতেই ফের ধর্ষণ করেছে ছোট্টু।
কিন্তু দ্বিতীয়বার এই ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে পুলিশ ও কিশোরীর পরিবারের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার ওই কিশোরীর পরিবার জানিয়েছে, থানা থেকে ফেরার পথে ওই কিশোরীকে তুলে নিয়ে অটোর মধ্যেই দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করে ছোট্টু। পরে তাকে মধ্যমগ্রাম স্টেশনে ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে কিশোরীকে উদ্ধার করে বাড়ি দিয়ে যায় রেল পুলিশ। |
এ প্রসঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছোট্টু ওই কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় বলে পরবর্তী অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সেখানে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের প্রসঙ্গ নেই। রেল পুলিশের কাছেও এ ব্যাপারে কিশোরী কিছু জানায়নি।”
পুলিশ সুপারের এই কথা অবশ্য মানতে চাননি কিশোরীর বাবা-মা। ওই কিশোরী নিজেও এ দিন বলে, “পুলিশের কাছে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের কথা আমিই জানিয়েছিলাম।” তার বাবা বলেন, “গণধর্ষণের কথা পুলিশকে জানাতে পারলাম, আর পরের ধর্ষণের কথা বলব না? আমরা তো বার বার সবাইকে একই কথা বলছি।”
পুলিশ কেন ওই কিশোরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করেনি? এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার বলেন, “ওই কিশোরী ও তার বাবার কথায় অসঙ্গতি রয়েছে।” পরে তিনি অবশ্য বলেন, “ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। গণধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। মূল অপরাধী ও তার সঙ্গী ধরা পড়েছে। অন্যদেরও খোঁজ চলছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় শরীরে আঘাত ও প্রাথমিক ভাবে ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। মেয়েটির শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। দ্বিতীয়বার ধর্ষণ নিয়ে যে ধোঁয়াশা রয়েছে, তদন্তের পরেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।”
মঙ্গলবার সকাল থেকেই পাটুলি-শিবতলায় ওই কিশোরীর বাড়িতে যান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মহিলা সংগঠন ও সাধারণ মানুষ। ওই কিশোরীর বাড়িতে এ দিনও রয়েছে পুলিশ পাহারা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ছোট্টু আর তার দলেরা এলাকায় অনেক দিন ধরেই দুষ্কর্ম করে বেড়াচ্ছিল। স্থানীয় বাঁশতলা বাজারে মাছ বিক্রি করে ছোট্টু। ওই কিশোরী তার কাছে মাছ কিনতে যেত। সেখানেই মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমায় সে। পরে ওই কিশোরীকে ফাঁসাবার পরিকল্পনা করে। মহিলারা জানান, ছোট্টু ও তার দলবলের নামে নেশা করে অসভ্যতা এবং মহিলাদের উত্যক্ত করার বেশ কিছু অভিযোগও রয়েছে। তবে দলবল নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনা এই প্রথম।
এ দিন কিশোরীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সারা গায়ে ক্ষত চিহ্ন নিয়ে মুখ ঢাকা দিয়ে ঘরের খাটের এক পাশে শুয়ে রয়েছে সে। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আতঙ্কে কেঁপে উঠছে। তার মা বলেন, “ওই ঘটনার পর থেকে আমরা একটুও ঘুমোতে পারিনি। এতটুকু মেয়ে কী করে এত কিছু সহ্য করবে!” বাবা বলেন, “পুলিশ, সাংবাদিক, নেতা, স্থানীয় মানুষকে ‘কী হয়েছে’ বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত। নিজের মেয়ের কষ্টের কথা বার বার বলতে ভাল লাগে?”
এলাকার তৃণমূল বিধায়ক তথা মধ্যমগ্রাম পুরসভার চেয়ারম্যান রথীন ঘোষ এ দিন মেয়েটির বাড়ি যান। জানতে চান, কোনও সাহায্য লাগবে কি না? কিশোরী ও তার পরিবার বলে, “আমরা কিছু চাই না। শুধু চাই দোষীদের ফাঁসি হোক।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রথীনবাবু বলেন, “সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য সিপিএম আশ্রিত কিছু সমাজবিরোধী এই জঘন্য কাজ করেছে। দোষীদের যাতে উপযুক্ত শাস্তি হয় আমরা সেটাই দেখব।” এ ব্যাপারে সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, “কামদুনি কাণ্ডে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যারা ধরা পড়েছে তারা কাদের লোক? আসলে সমাজবিরোধী, ধর্ষকরা মনে করছে এটা তাদেরই রাজত্ব।” আর রাজ্যে মহিলাদের উপর অপরাধমূলক কাজকর্ম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যর মন্তব্য, “এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কেন নির্লজ্জের মতো এই জিনিস বরদাস্ত করছেন!”
|