|
|
|
|
হারপিকে ফুটো বধূর ক্ষুদ্রান্ত্র, পলাতক বিদেশফেরত স্বামী
আরিফ ইকবাল খান • হলদিয়া |
বছর ছাব্বিশের তরুণী। চলতি বছরের গোড়ায় ধূমধাম করে যখন বিয়ে হল, তখনও আনন্দে পা পড়ছিল না মাটিতে। বছর না পেরোতেই হলদিয়ার ভবানীপুর থানার বাবাজিবাসার সেই জয়িতা বেরা যেন পাথরপ্রতিমা। অভিযোগ, পণের দাবি না মেটানোয় জয়িতাকে গলা টিপে ‘হারপিক’ খেতে বাধ্য করেন স্বামী শান্তনু হাজরা। অ্যাসিডের তীব্রতায় খাদ্যনালী এমন সঙ্কুচিত হয়েছে যে, ক্ষুদ্রান্ত্র ফুটো করে নল লাগিয়ে তরল খাদ্য চলছে ১৭ অগস্ট থেকে। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলারও ক্ষমতা নেই কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে মাস্টার্স ওই তরুণীর। খুব কষ্ট করে বললেন, “এত উচ্চশিক্ষিত বাড়ি, স্বামী ভাল চাকুরে অনেক দেখে বাবা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিয়ে দেন। তাই মাস পেরোতেই অত্যাচার শুরু হলেও সঙ্কোচে বাড়িতে কিছু বলতে পারিনি।”
১৫ অগস্ট দুর্গাচকের শ্বশুরবাড়িতে ওই ঘটনার পরে গুরুতর অসুস্থ জয়িতাকে স্থানীয় এক নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে প্রথমে হাওড়া ও পরে কলকাতার হাসপাতাল। কলকাতার হাসপাতালের ‘ডিসচার্জ সার্টিফিকেট’ বলছে, খাদ্যনালী পুড়ে সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে, সংক্রমণ ফুসফুসেও। এক মাসের উপর নানা হাসপাতালে ছিলেন জয়িতা।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ৮ অক্টোবর দুর্গাচক থানায় এফআইআর করেন জয়িতা। সেই মতো তাঁর শাশুড়ি সবিতা হাজরাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এখনও জেলে। তবে, স্বামী শান্তনু পলাতক। পূর্ব মেদিনীপুরের এসপি সুকেশ কুমার জৈন বলেন, “এমন ঘটনা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখি। ওঁর খোঁজে কর্মক্ষেত্র-সহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান হয়েছে। কোথাও দেখা মেলেনি।” ৬ নভেম্বর শুনানি রয়েছে হলদিয়া আদালতে।
|
নলের সাহায্যে খাচ্ছেন জয়িতা। —নিজস্ব চিত্র। |
জয়িতার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত বন্দরকর্মী শক্তিপদ হাজরা অবশ্য বধূ নির্যাতনের অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “এফআইআর-এর অভিযোগ ঠিক নয়। ওটা আত্মহত্যার চেষ্টা। বৌমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ আমিই দিয়েছি।”
গত ৩১ জানুয়ারি জয়িতার বিয়ে হয় সেক্টর ফাইভে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত বিদেশ ফেরত শান্তনুর সঙ্গে। হলদিয়ারই দুর্গাচকে শান্তনুর বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী থাকতেন কলকাতার ফ্ল্যাটে। জয়িতার বাবা প্রাক্তন নৌ সেনা বিধুদান বেরার দাবি, মেয়ের বিয়েতে নগদ দু’লক্ষ টাকা ছাড়াও ৩০ ভরি সোনার গয়না, মাইক্রোওভেন, ফ্রিজ-সহ নানা জিনিস দিয়েছি। তার পরেও অতিরিক্ত পণের দাবি জানাত জয়িতার শ্বশুরবাড়ি। জয়িতার মা কল্যাণীদেবীর অভিযোগ, “বিয়ের দু’মাস পর আরও চার লক্ষ টাকা চায় জামাই। মেয়ে আমাদের তা বলতে না পারায় অত্যাচার শুরু হয়। পাশের ফ্ল্যাটে যাতে আওয়াজ না যায়, সে জন্য মুখে লিউকোপ্লাস্ট আটকে দিত ওর শাশুড়ি। মেয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করছিল।” জয়িতার কথায়, “একমাত্র মেয়ের এই পরিণতি শুনলে বাবা-মা ভেঙে পড়বেন। তাই প্রথমটা কিছু বলিনি। পরিণতি এতটা খারাপ হতে পারে ভাবিনি তখন।” রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের মতে, “মেয়েরা যতটা পারে এগুলো চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। স্বামী, সংসার, সন্তান শব্দগুলো আঁকড়ে তিলে-তিলে মরে।” জয়িতার বান্ধবী বিদিশার কথায়, “জয়িতার মতো নিরীহ, সরল মেয়ের এই পরিণতি ভাবা যায় না!”
শান্তনুকে অবশ্য অফিসে ভদ্র, মার্জিত হিসেবেই পরিচিত। তাই এমন অভিযোগ বিশ্বাস করতে পারছেন না সহকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকর্মীর কথায়, “ওদের স্বামী-স্ত্রীতে অশান্তি চলছিল টের পেয়েছি। শান্তনু অফিসেও মুষড়ে থাকত। তা বলে এমন অভিযোগ মানতে পারছি না।” সংস্থার হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের তরফে সঞ্চয়ন ভট্টাচার্য বলেন, “শান্তনুর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগের কথা অফিসের জানা নেই।”
তবে উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত স্বামীদের বিরুদ্ধেও বধূ নির্যাতনের অভিযোগ আসে বলে জানান পুলিশকর্তারা। সংখ্যায় কিছুটা কম। হলদিয়ার এসডিপিও অমিতাভ মাইতির মতে, “দশটার মধ্যে হয়তো দু’টো।” সুনন্দাদেবীও বলেন, “বহু ডাক্তার, অধ্যাপকের বিরুদ্ধে পণের জন্য নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছি। মনে রাখতে হবে, যত ঘটনা ঘটে, তার নামমাত্রই আমাদের কানে আসে।” |
|
|
|
|
|