হিন্দুদের বিয়ের ব্যবস্থাটিকে মেয়েদের প্রতি আর একটু সমদর্শী করে তুলতে সম্প্রতি রাজ্যসভায় হিন্দু বিবাহ আইন (১৯৫৫) আর বিশেষ বিবাহ আইন (১৯৫৪), এই দু’টি আইনের কিছু ধারার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এই সংশোধনের দু’টি লক্ষ্য: বিচ্ছেদকে আর একটু সহজ করে তোলা এবং বিচ্ছেদের পরেও স্ত্রীদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা। তবে লোকসভায় সংশোধন-সহ পাশ হয়ে আইনটি শেষ পর্যন্ত কী চেহারা নেবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
আমাদের দেশে হিন্দু নারী বা পুরুষ যে-সব কারণে এত দিন বিয়ে ভাঙার বা বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারতেন, সেগুলি অপর পক্ষের কোনও দোষ বা সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভর করত। অত্যাচার, সারানো অসম্ভব এ রকম মানসিক অসুস্থতা, ছোঁয়াচে বা কুষ্ঠরোগ, যৌনরোগ, সন্ন্যাস বা ধর্ম পরিবর্তন অথবা সাত বছর নিরুদ্দেশ এই সব কারণে অন্য পক্ষ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারতেন। এ ছাড়াও স্বামী যদি ধর্ষণে অভিযুক্ত বা অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়ায় রত হন, তা হলে স্ত্রীরা বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারতেন। বিশেষ বিবাহ আইনেও একই কারণে বিচ্ছেদ চাওয়া যেত। সব ক’টিই প্রমাণসাপেক্ষ, এই নিয়ে আদালতে প্রচুর কাদা ছোড়াছুড়িই রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল।
এটা বাস্তব যে, নানা কারণে দু’টি মানুষের ব্যক্তিত্বে মিল না-ই হতে পারে, তাঁরা মনে করতেই পারেন যে তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে খাপ খান না কিন্তু তাঁরা কেউ অন্যের সম্বন্ধে কোনও অভিযোগ আনতে চান না, কারণ তাঁদের সত্যিই তেমন কিছু অভিযোগ নেই। এ জন্য পশ্চিমি দেশগুলি বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে ‘কোনও পক্ষের কোনও দোষ ছাড়াই সম্পর্কটি চিরতরে ভেঙে গেছে’ বা ‘নো ফল্ট’, আইনি ভাষায় ‘ইরিট্রিভেবল ব্রেকডাউন’ বলে বিচ্ছেদের অনুমতি দেয়। সেই চিরতরে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াই এ বার বিচ্ছেদের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হবে বলে সংশোধনী এসেছে। সেই সঙ্গে যাঁরা পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে বিচ্ছেদ চান, তাঁদের জন্য বিচ্ছেদের আবেদন দাখিল করার পর ৬-১৮ মাস বাধ্যতামূলক অপেক্ষার শর্তও শিথিল করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের মতো দেশে স্বামীদের হাতে এটি যাতে একটি অস্ত্র না হয়ে ওঠে, সেটি সুনিশ্চিত করতে স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর পাশাপাশি, বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী আবেদন করলে বিচারপতি সন্তান ও স্ত্রীর জন্য স্বামীর আর্থিক ক্ষমতা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন। ওই হিসেব করার সময় স্বামী উত্তরাধিকার সূত্রে কী পেয়েছেন বা কী পেতে পারেন ও অন্য স্থাবর সম্পত্তির প্রয়োজনীয় অংশ, অস্থাবর সম্পত্তির অংশ থেকে বিচারক স্ত্রীকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবেন। |
ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। বাস্তবে দেখা যায়, বেশির ভাগ মেয়ে আমাদের দেশে ‘বিচ্ছিন্ন’ হন না, ‘পরিত্যক্ত’ হন, স্বামীরা তাঁদের ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে অন্যকে ‘বিয়ে’ করে সংসার পাতে, সেখানে কোনও আইনি বিচ্ছেদ হয় না। সেই মেয়েরা কী পাবেন? আর যে সব মেয়ের স্বামীদের স্থাবর-অস্থাবর কোনও সম্পত্তিই নেই, তাঁরাই বা কী পাবেন? বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামী পরিত্যাগ করেছে বলেই স্ত্রীরা বেশ কিছু দিন পরে খোরপোষ দাবি করেন আর তখনই স্বামীরা বিচ্ছেদের আবেদন করে। নারী আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, বহু মেয়ে ডিভোর্সটাকে আটকে রেখে আর্থিক সমঝোতার চেষ্টা করেন। বিচ্ছেদ সহজ হলে কি তাঁরা সমস্যায় পড়বেন? এমনকী যখন মেয়েরা ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ ধারা প্রয়োগ করে আদালতের আদেশে কোনও খোরপোষ পান, সেটাও দু-এক কিস্তির পর বন্ধ হয়ে গেলে দেখার কেউ নেই। আর স্বামীর কী কী স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে, স্বামী উত্তরাধিকার সূত্রে কী পেয়েছে, কী পেতে পারে, কতটা আয় গোপন করেছে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি এ সব বিচার করতে বসেন কারণ স্বামীরা সব সময়েই প্রকৃত তথ্য গোপন করবে তা হলে আদতে ক’টি মেয়ে ক’দিনে ক্ষতিপূরণ হাতে পাবে? এমনিতেই অভিজ্ঞতা বলছে, বিয়ে ভাঙলে বিয়েতে নেওয়া পণের টাকা, বিয়ের গয়না, যেগুলি আদতে স্ত্রীধন, এমনকী সার্টিফিকেট পর্যন্ত আটকে রেখে হেনস্থা করতে চেষ্টা করে, তারা কি আদৌ সুবোধ বালকের মতো বিচারককে এ সব তথ্য জানিয়ে দেবে? বিচ্ছিন্না মেয়েদের নিজেদের আর্থিক সংস্থান না থাকলে তাঁদের খোরপোষ হোক বা ক্ষতিপূরণ তাড়াতাড়ি হাতে পাওয়া প্রয়োজন, এই সংশোধন তা সুনিশ্চিত করছে না। শুধুমাত্র বিচারকদের বিবেচনার উপর অংশ বিচারের এই ভার ন্যস্ত থাকলে মেয়েরা শেষ পর্যন্ত কী পাবেন? আদালতের রায়ে যে মেয়েরা সব সময় সমান সুবিচার পায়, সেটা হলফ করে বলা যায় কি? সাক্ষী, স্বয়ম্, এ রকম নানা সংগঠনের সমীক্ষায় কিন্তু অন্য কথাই উঠে এসেছে।
আসলে ভাল আইন থাকলেই কারও ভাল হয় না, যদি-না তা প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করা হয়। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আরও ভাল ভাল আইন আসতে পারে, কিন্তু তা প্রয়োগের জন্য অর্থ ও জনসংস্থানের ব্যবস্থা না করলে বিবাহ বিচ্ছিন্নাদের কী-ই বা লাভ? এই বিষয়টি সংসদের বিবেচনায় না এলে ও রাজ্য স্তর পর্যন্ত প্রয়োগের ব্যবস্থা না থাকলে এই সব সংশোধনের সুযোগ নিতে পারবে শক্তিশালী পক্ষটিই।
অন্যান্য কিছু সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। এটা অনস্বীকার্য, স্ত্রীরা যদি স্থাবর সম্পত্তির অংশ পান, তা হলে পরিবারের অন্য মেয়েদের, যেমন মা বোন এঁদের অংশ কমে যাবে। এ ছাড়া স্ত্রী যদি সচ্ছল হন, তা হলে সেই স্ত্রী কেন ক্ষতিপূরণ পাবেন? তাঁর আর্থিক অবস্থাও খতিয়ে দেখার কথা বলা হোক। বিয়ে কত দিন টিকলে তবে স্ত্রীরা স্বামীর সম্পত্তির অংশ দাবি করতে পারবেন, সেটাও নির্দিষ্ট করা দরকার। যে সম্পত্তিতে মেয়েদের বিনা মজুরির শ্রমের অংশ আছে, তার অংশ তাঁদের দেওয়ার দাবি নারী আন্দোলনের। যে দেশে বিয়ে ‘দেওয়া’ হয়, সে দেশে মেয়ের দায়িত্ব একা স্বামীর নয়, বিয়ে ভাঙলে সমান তালে বাপের বাড়িকেও নিতে হবে। বিয়ে ভাঙলে বাবা বা ভাই যদি সেই মেয়েকে বাড়িতে রাখতে না চায়, তাদের বিরুদ্ধেও আদালত ব্যবস্থা নেবে বলে আইনে বলা হোক।
তবে আরও একটি মোক্ষম কথা বলেছেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নাতনি নাজমা হেপতুল্লা। বলেছেন, কেন এ সব আধুনিক ভাবনার সুফল কেবল ভোগ করবে হিন্দুরাই (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন), দেশের বাকি নারীরা ধর্মের কালো আচ্ছাদনেই পড়ে থাকবেন? |