প্রবন্ধ ১...
সাইকেল না গাড়ি, রাস্তা কার জন্য

সাইকেল চালিয়ে অফিস গেলে সামনের বছর মাইনে খানিক বেশিই বাড়ত কি না, ভেবে দেখেছেন? সরকারি চাকুরেদের কথা বলছি না অবশ্য। যাঁদের মাইনে বাজারের ওপর, অর্থনীতির হালহকিকতের ওপর নির্ভর করে, তাঁদের কথা বলছি। গত বছর তিনেক তাঁরা টের পেয়েছেন, কী ভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব তাঁদের মাসপয়লায় পড়ে। এই বছর ডলারের তুলনায় টাকার দাম যে রকম ধরাশায়ী হয়েছে, তাতে ফের সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না।
কেন ডলারের দাম এমন আকাশছোঁয়া হল, এই প্রশ্নটা করলেই ঝাঁকে ঝাঁকে তত্ত্ব আর যুক্তি ধেয়ে আসে। কিন্তু মূল কথাটা তো হল এই যে ভারত বিদেশ থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তত পণ্য বিদেশের বাজারে রফতানি করে না। ফলে, ধারের খাতা ক্রমে ফুলেফেঁপে ওঠে। কাজেই, আমার-আপনার মাইনে বাড়ানোর জন্য যদি ডলারের দাম কমানোর প্রয়োজন হয়, তা হলে এই ধারের বোঝা কমানো ছাড়া উপায় নেই। সবচেয়ে বেশি ধার হয় তেল আমদানি করতে। কাজেই, পেট্রোল-ডিজেলের ব্যবহার কমানো গেলেই এই সমস্যার অনেকখানি সমাধান হতে পারে। সেই কারণেই সাইকেলে চেপে অফিস যাওয়ার কথা বলছিলাম।
ইয়ার্কি ভেবে হেসে উড়িয়ে দিতেই পারেন। তবে, কথাটাকে আর একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবলে দেখবেন, মহা মুশকিল। কলকাতার মতো শহরে আসলে সাইকেল চালিয়ে কোথাও যাওয়া কার্যত অসম্ভব। মাসখানেক আগে কলকাতা পুলিশ নিয়ম করে দিল, শহরের রাস্তায় আর সাইকেল চালানো যাবে না। তা নিয়ে খানিক হইচই হল। গাঁধীজয়ন্তীর দিন চক্র সত্যাগ্রহ হল। যাঁরা সাইকেলপন্থী, তাঁরা পুলিশের এই সিদ্ধান্তে মর্মান্তিক চটেছেন। কিন্তু সত্যিই ভেবে দেখুন তো, কলকাতার রাস্তার যা অবস্থা, তাতে কি সাইকেল চালাতে দেওয়া উচিত? একটা হিসেব বলছে, গত পাঁচ বছরে কলকাতার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। অন্য দিকে, আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে যেখানে শহরের পরিসরের অন্তত ৩০ শতাংশ রাস্তা হওয়া প্রয়োজন, কলকাতায় সেখানে মাত্র চার শতাংশ। দিল্লির তুলনাতেও ঢের কম। তা-ও সে হিসেব নিতান্তই খাতায় কলমে। শহরের প্রায় সব ফুটপাথই দখল হয়ে আছে, ফলে মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য। কাজেই, রাস্তার মাপ আরও কমেছে। অর্থাৎ, কলকাতার নামমাত্র রাস্তায় বহু গাড়ি একটু জায়গার জন্য আক্ষরিক অর্থেই মারামারি করছে। শহরের ট্রাফিক শ্লথ, বললে কিছুই বলা হয় না। এই অবস্থায় সত্যি কি রাস্তায় সাইকেল চালাতে দেওয়া যায়?

অন্য শহরে। দিল্লির রাস্তায় সাইকেল সফর। ছবি: পিটিআই।
কিন্তু, গোটা দুনিয়া যখন সাইকেলের মতো পরিবেশ-বান্ধব পরিবহণকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন কলকাতার বাস কন্টাকটরদের পরামর্শ মেনে ‘পিছন দিকে এগিয়ে’ যাওয়াটাও তো কোনও কাজের কথা নয়। শহরের রাস্তায় সাইকেল চালাতে দিতে হলে তার জন্য আলাদা ‘লেন’ চাই। কলকাতার সরু রাস্তায় সেই লেন কি তৈরি করা সম্ভব? হ্যাঁ, কিন্তু তার জন্য রাস্তায় এত গাড়ি থাকলে চলবে না। অর্থাৎ, সবাই যদি নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে যান, তা হলে সাইকেলের জন্য রাস্তা করে দেওয়া সম্ভব নয়। এখানে একটা রাজনীতির প্রশ্ন আছে যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা কাদের বেশি গুরুত্ব দেবেন, যাঁরা নিজেদের গাড়িতে চড়েন, নাকি যাঁরা সাইকেল চাপতে চান? আপাতত এই প্রশ্নটাকে সরিয়ে রাখা যাক। ভেবে নিই, গাড়িওয়ালাদের প্রতি নেতাদের বিশেষ কোনও ভালবাসা নেই।
কিন্তু, প্রশ্নটা তো ব্যক্তিগত গাড়ি বনাম সাইকেলের নয়। সরকার আজ বাদে কাল নিয়ম করতেই পারে, কলকাতার শহরাঞ্চলে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঢুকতে চাইলে বিশেষ ছাড়পত্র লাগবে, এবং সেটা কিনতে অনেক টাকা রাজস্ব দিতে হবে। শহরে গাড়ি পার্কিং-এর খরচও না হয় বিপুল পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু, তা হলেই কি সবাই গাড়ি ছেড়ে সাইকেল চড়বেন? তা নয়। এখানেই গণপরিবহণের গুরুত্ব। কলকাতার বাসগুলো যদি চড়ার মতো হত, মেট্রো রেল যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটুও আধুনিক হয়ে উঠত, হয়তো অনেকেই নিজের গাড়ির বদলে বাসে-মেট্রোয় যাতায়াত করতেন। এক জন মানুষের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি যতখানি রাস্তা দখল করে, বাস সে তুলনায় কিছুই করে না। গাড়ির বদলে অনেকে যদি বাসে চড়তেন, তা হলেই সাইকেলের জন্য যথেষ্ট রাস্তা পাওয়া যেত। দুনিয়ার বহু সভ্য শহরে তা-ই হয়। কিন্তু, কলকাতা তো অসভ্য।
কলকাতার বাসগুলোর দিকে তাকালে ভয় করে। নিয়মিত তাতে চড়তে হয়, কিন্তু তা গত্যন্তর নেই বলেই। যাঁদের অন্য উপায় আছে, তাঁরা বাসে চাপতে যাবেন কেন? বাসগুলো যদি চড়ার মতো হত, তা হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। কিন্তু, এখানেও আর একটা রাজনীতির প্রশ্ন। নেতারা গরিব মানুষের দোহাই দিয়ে বাসভাড়া বাড়াতে দেন না। যে ভাড়ায় এখন বাস চলে, তাতে সম্ভবত রোজকার খরচই ওঠে না। ফলে, বাসের রক্ষণাবেক্ষণ প্রশ্নাতীত। বছর কয়েক আগেই কলকাতার রাস্তায় চমৎকার দেখতে কিছু বাস নেমেছিল, জওহরলাল নেহরু জাতীয় নগর পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের আর্থিক সহায়তায়। সেই বাসগুলো এখন হতশ্রী। কলকাতার রাস্তার এই বাসগুলোয় কেউ স্বেচ্ছায় চড়বেন বলে মনে হয় না। অথচ, মানুষ যে বাসে চড়তেই চান না, তা-ও নয়। এই শহরেই যে বাতানুকূল ভলভো বাস চালু হয়েছে, নিয়মিত লাইন দিয়ে তাতে চড়েন অনেকেই। এই বাসগুলোয় কিন্তু ন্যূনতম কুড়ি-পঁচিশ টাকা ভাড়া দিতে হয়। এই রকম বাস শহর জুড়ে, সব রুটে চললে মানুষ চড়বেন না, কে বলল? আর, যাঁদের পক্ষে রোজ এত টাকা বাসভাড়াবাবদ খরচ করা সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য সস্তার বাসও থাকতেই পারে, কিন্তু ঠিক এতটা সস্তা নয়। মানুষ আপত্তি করবেন না। অটোওয়ালাদের মর্জিমাফিক ভাড়া গুণে বাড়ি ফেরার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তো।
কিন্তু কলকাতা উল্টো পথেই চলবে। মেট্রোয় বহু বছর আগে ভাড়া বাড়ানো উচিত ছিল। এত দিনে যখন খানিক ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হল, নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন আটকাতে। তাঁরা ভারতের অন্য শহরগুলোর মেট্রো ভাড়া সম্ভবত জানেন না। সেখানকার পরিষেবার মানের কথাও নয়। ভাড়া বাড়তে না দেওয়ার এই রাজনীতি যত দিন থাকবে, তত দিন গণপরিবহণ কিছুতেই সর্বজনীন হবে না। যাঁরই সাধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি কুলোবে, তিনিই আর গণপরিবহণের ধার ঘেঁষবেন না। তাতে শহরের ক্ষতি। গাড়ির চাপে শহরের রাস্তা কার্যত অনড়। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে তেল পোড়ায় গাড়িগুলো। সেই দূষণ হাওয়ায় মেশে। অন্য দিকে, যাঁদের গাড়িও নেই, বাসে চড়ার মতো শরীর-মনের জোরও নেই, তাঁরা অটো-নির্ভর। কত অটো এখনও কাটা তেলে চলে, কত দূষণ ছড়ায়, সেই প্রশ্ন অন্য কোনও লেখার জন্য তোলা থাক।
বরং, একটা অন্য প্রশ্ন তুলি। কলকাতায় গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে। আরও হচ্ছে। একটা-দুটো ভেঙেও পড়ছে, কিন্তু সে কথা থাক। এই ফ্লাইওভার কিন্তু শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য। আর, সেই ফ্লাইওভারের জন্য রাস্তার যে অংশ খোয়া যাচ্ছে, তা কাটা পড়ছে গণপরিবহণের ভাগ থেকে। এই শহরটা আসলে কাদের জন্য, বুঝতে অসুবিধে হয় না।
শহরের রাস্তা খালি করার জন্য ফুটপাত খালি না করলেই নয়। আচ্ছা, ফুটপাত কাদের দখলে? এই প্রশ্নের উত্তরে দশ জনে দশ জনই হকারদের কথা বলবেন। তাঁরা তো আছেনই, কিন্তু তাঁরাই একমাত্র নন। রাস্তার পাশের দোকানের শো-রুম এখন ফুটপাতে নেমে এসেছে। কত দোকানের পণ্যের পসরা যে ফুটপাতে সাজানো থাকে, তার ইয়ত্তা নেই। পুলিশের সঙ্গে মাসকাবারি ব্যবস্থা থাকে তাঁদের। ফুটপাতের অবৈধ দখলদারদের তালিকায় রয়েছে গৃহহীন পরিবারগুলোও। সত্যি, তাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু, ফুটপাতের অধিকার তাদের হাতে ছেড়ে দিলে শহরটাই বা যাবে কোথায়? নেতা-মন্ত্রীরা ফুটপাতের সমস্যা নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। ভাবলে, পুরসভার ভ্যাট থেকে বাসস্ট্যান্ডের ছাউনি, সবই কি ফুটপাত দখল করেই থাকত?
দেখুন, কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম! হচ্ছিল শহরের রাস্তায় সাইকেল চালানোর কথা, গিয়ে পড়লাম ফুটপাত দখলের গল্পে। সমস্যাটা আসলে এখানেই। সব কিছু একটার সঙ্গে আর একটা জড়ানো। রাস্তায় সাইকেল চালানোর অধিকার চাইতে হলে গণপরিবহণ ব্যবস্থা শুধরানোর দাবি করতে হবে, ভাড়া না বাড়ানোর লোক-দেখানো জনদরদ বন্ধ করার দাবি করতে হবে। পথচারীকে ফুটপাতের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলতে হবে। এর সমস্তটা না হলে শুধু সাইকেল চালানোর অধিকার দাবি করা অর্থহীন।
প্রশ্ন হল, এতগুলো দাবি আপনি-আমি করব কি না। যদি জানি, এই দাবিগুলো পূরণ হওয়ার সঙ্গে সামনের এপ্রিলের মাইনে বাড়া জড়িয়ে আছে, তা হলেও কি করব না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.