বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও রক্তপাত অব্যাহত। গত কয়েক মাস ধরিয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ‘ঘাতক’ রাজাকারদের বিচার ও দণ্ডাদেশের প্রতিবাদে এই অরাজকতা চরমে ওঠে। এখন জাতীয় সংসদ তথা পার্লামেন্টের নির্বাচন আসন্ন হইয়া ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে রাজনীতির হাওয়া গরম করার উত্তেজক প্রচেষ্টা চলিয়াছে। বিরোধী দল বিএনপি একটি তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে নির্বাচিত আওয়ামি লিগ সরকারের ইস্তফার জন্য চাপ দিতেছে। বস্তুত, সেই দাবিতেই তিন দিনের হরতাল ডাকিয়া দেশময় হিংসা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তদারকি সরকারের দাবিতে সম্মত নহেন। তিনি অবশ্য একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনে সম্মত। কিন্তু তাহাতেও বিরোধী দলকে খুশি করা যায় নাই।
দেশের নবীন গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা দুর্ভাগ্যজনক যে, ফৌজি শাহির অবসানের পর যে শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশে কায়েম হইয়াছে, তাহাতে দুই প্রধান দলের নেত্রীরা কোনও প্রশ্নেই সহমত হইতে পারেন না। মতভেদ, এমনকী মতবিরোধ গণতন্ত্রে স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিরোধ যদি দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখ দেখাদেখি ও বাক্যালাপ বন্ধের নামান্তর হয়, তাহা স্বাস্থ্যকর নয়। তৎসত্ত্বেও যখন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বিগত এক দশকে এই প্রথম টেলিফোন তুলিয়া বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে হরতাল প্রত্যাহার করিয়া তদারকি সরকার বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন, তখন সম্পর্কের শৈত্য ঘুচিয়া বরফ গলার ইঙ্গিত মিলিতেছিল। বেগম জিয়া সেই বিভ্রম ভাঙিয়া দিয়া হরতালেই অবিচল থাকিয়াছেন। অথচ গণতন্ত্রে কিন্তু সরকার পরিবর্তন করিয়া ক্ষমতা দখলের বৈধ ও সর্বজনগ্রাহ্য রীতি, পদ্ধতি, প্রকরণ রহিয়াছে। দেশের সংবিধানও সেই পদ্ধতি ও প্রকরণগুলিই অনুমোদন করে। পাঁচ বৎসর অন্তর জনাদেশ লইয়া ক্ষমতাসীন হওয়াই সেই রীতি এবং তাহার অনুষ্ঠানও ক্ষমতাসীন অথচ বিদায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানেই হওয়ার কথা। বিএনপি নেত্রী যাহা দাবি করিয়াছেন, সেই তদারকি সরকার তাঁহার নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের অন্তে নিযুক্ত হইয়াছিল। তাহার পরিণাম যে তাঁহার নিজের, পরিবারের ও দলের পক্ষেও কল্যাণকর হয় নাই, ইতিহাস তাহার সাক্ষী। তথাপি তিনি সেই অসাংবিধানিক বন্দোবস্তটি ফিরাইয়া আনিতে উদ্গ্রীব!
অথচ একের-পর-এক স্থানীয় নির্বাচনে ইতিমধ্যেই সংকেত মিলিয়াছে যে, আওয়ামি লিগের সরকার জনপ্রিয়তা হারাইতেছে। ইহা খুবই সম্ভব যে, আগামী নির্বাচনে হাসিনা ওয়াজেদের দল পরাস্ত হইবে এবং বিএনপি ক্ষমতায় ফিরিবে। কিন্তু সে জন্য একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। তাহার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি সরকারেরই দায়িত্ব। বিরোধী রাজনীতির কাজ গণতান্ত্রিক উপায়েই সেই দায়িত্ব পালনে সরকারকে বাধ্য করা। সংবিধান-বহির্ভূত যে কোনও বন্দোবস্তই গণতন্ত্রে অন্তর্ঘাত হানার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে এবং কায়েমি স্বার্থচক্রীদের সুযোগ করিয়া দেয়। তথাপি কেন বারংবার তদারকি সরকারের ধুয়া উঠিতেছে? প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় বিরোধী নেত্রীর সহিত কথা বলিবেন, তাঁহার যাবতীয় বক্তব্য, অভিযোগ, দাবি মন দিয়া শুনিবেনও। দেশবাসীর মঙ্গলচিন্তাই যদি উভয়ের বিবেচ্য হয়, তবে অহমিকা কিংবা জেদের লড়াই করিয়া তো কোনও লাভ নাই। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও রীতিপদ্ধতি বিসর্জন দিয়া কিছু করা উচিত নয়। |