পটনার গাঁধী ময়দানে নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় একের-পর-এক বোমা বিস্ফোরণ ও তাহাতে বেশ কিছু মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনাটি অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অবাঞ্ছিত এবং প্রত্যাশিত। বিহার যেহেতু সংযুক্ত জনতা দল শাসিত, এই সে দিন অবধি বিজেপির সহিত যাহার রাজনৈতিক আঁতাত ছিল, এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যেহেতু বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর কট্টর বিরোধী, তাই পটনার গাঁধী ময়দানে অনুষ্ঠিত মোদীর জনসভায় এমন বিস্ফোরণ সকল পক্ষকেই রাজনীতি করার সুবর্ণ সুযোগ আনিয়া দিয়াছে। কেহ যদি ষড়যন্ত্রের গল্প ফাঁদিতেছেন, অন্য কেহ তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ইচ্ছাকৃত গাফিলতির অভিযোগ তুলিতেছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে ইহাই এখন স্বাভাবিক। নির্বাচন যত আসন্ন হইবে, এই প্রবণতা তত বৃদ্ধি পাইবে, এমন আশঙ্কাই প্রবল। নির্বাচনী রাজনীতিতে নানা রকম চমকের প্রয়োজন হয়, নানা অপ্রত্যাশিত মোড় ও বাঁকের দেখা মিলিতে থাকে। রাজনীতিকরা তাহার পরিপূর্ণ ব্যবহার করিতে সতত তৎপর। ইহাই বাস্তব।
কিন্তু এই কু(ৎসিত)নাট্যের বাহিরে একটি গুরুতর সত্য এই সন্ত্রাসী ঘটনায় নূতন করিয়া প্রকট হইয়াছে। তাহা হইল নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি। প্রথমত, এই ধরনের বহুবিজ্ঞাপিত, উচ্চগ্রামের জনসভায় যে ধরনের নিরাপত্তা বলয় থাকা উচিত, আগাম গোয়েন্দা তৎপরতা, জঙ্গিদের সম্ভাব্য পরিকল্পনা ও গতিবিধি সম্পর্কে যে পর্যায়ে তথ্যের আদানপ্রদান ও তদনুযায়ী নিশ্ছিদ্র নিবারক বন্দোবস্ত গড়িয়া তোলা আবশ্যক, গাঁধী ময়দানের জনসভার ক্ষেত্রে তাহার অভাব ছিল, এমন সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্যকে ষোলো আনা রাজনীতির কৌশল বলিয়া তুচ্ছ করিবার কোনও কারণ নাই। এ কথা ঠিক যে, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও তৎপরতাই শেষ বিচারে সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র হইতে পারে না। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, জঙ্গি তৎপরতার আগাম পূর্বাভাস পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। বস্তুত, পাশ্চাত্যে সন্ত্রাসীদের একাধিক হামলার ছক আগাম উদ্ঘাটন করিয়া বহু বিপর্যয় এড়ানো গিয়াছে। ভারতের মতো দেশেও জেহাদি হামলার একাধিক পরিকল্পনা আগাম জানিয়া ফেলায় যথাসময়ে তাহা নিষ্ক্রিয় করা গিয়াছে। এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে সদাজাগ্রত থাকিতে হইবে এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সংস্থার সহিত নিবিড় সমন্বয় সাধন করিয়া তথ্যের আদানপ্রদান করিতে হইবে।
ইহা তখনই সম্ভব হইতে পারে, যখন নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তাকে অন্যান্য যাবতীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে প্রস্তুত। সন্ত্রাসী, জেহাদি বা জঙ্গির কোনও জাত নাই, ধর্ম নাই, সম্প্রদায়ও নাই। তাহার একটিই পরিচয় সে নৃশংস ঘাতক। যাহারা মানুষ মারার কারিগর, নারীশিশুবৃদ্ধ নির্বিশেষে অসামরিক, নিরস্ত্র, নিরীহ প্রাণ হরণ করিতে সঙ্কল্পবদ্ধ, তাহারা কোন ধর্মের বা সম্প্রদায়ের, ইহা বিবেচনা করার কোনও যুক্তি থাকিতে পারে না। কিন্তু দেশের নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়শ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অনমনীয় হইতে পারে না, কারণ নির্বাচনী পাটিগণিতের রকমারি পিছুটান তাহার হাত-পা বাঁধিয়া রাখে। উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রতিক কালে ইহার একাধিক নমুনা দেখা গিয়াছে। সন্ত্রাসদমন তথা জন-নিরাপত্তা বিধানের রাষ্ট্রীয় কৃত্যের সহিত কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা সাম্প্রদায়িকতা, কোনওটিরই কোনও সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথার্থ নিরপেক্ষ এবং কঠোর হইলে তবেই প্রশাসনিক দফতর ও সংস্থাগুলি তৎপরতার সহিত সন্ত্রাস মোকাবিলার সুযোগ পাইবে। |