ছদ্মবেশ ধরতে তার জুড়ি নেই। তাই তাকে চেনা কঠিন। ফলে পাকড়াও করাও।
তেহসিন আখতার সম্পর্কে এমনটাই মনে করছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ। তারা মনে করছে, পটনায় বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেও ছদ্মবেশ ধরেই শেষ পর্যন্ত এই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) জঙ্গি কাজ সারে। প্রশ্ন হল, কী ধরনের ছদ্মবেশ নেয় তেহসিন?
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, চেহারা পাল্টানোয় এই জঙ্গি নেতা ভেল্কি দেখায় বলেই জেনেছেন তাঁরা। তার সব থেকে প্রিয় ছদ্মবেশ হল টুরিস্ট গাইড। ঠিক যেন ‘ফনা’ সিনেমায় জঙ্গি রেহান খানের মতো। আমির অভিনীত ওই ছবিতে রেহান ছিল জঙ্গি নেতা। টুরিস্ট গাইড সেজে সে এলাকা ঘুরে দেখত। নিজের ছক সাজাত। পর্যটকদের সঙ্গে থাকতে থাকতেই নিজের কাজ সেরে ফেলত স্বচ্ছন্দে।
|
তেহসিন আখতার। |
গোয়েন্দারা বলছেন, বছর তেইশের আইএম জঙ্গি তেহসিনও একই পদ্ধতি নিয়েছিল পটনার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, গাইডের ছদ্মবেশে সে পর্যটকদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে প্রথমে হামলার সম্ভাব্য জায়গাগুলি রেকি করে গিয়েছিল। কেউ তাকে সন্দেহ করেনি। আবার কাজ সেরে কোনও পর্যটক দলের সঙ্গে মিশেই হয়তো এলাকা থেকে গা ঢাকা দিয়েছিল সে। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, গাঁধী ময়দানে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় জমে। ফলে টুরিস্ট গাইডের ছদ্মবেশে সেখানে রেকি করতে তেহসিনের কোনও অসুবিধাই হয়নি।
তেহসিন-কাহিনি অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এনআইএ সূত্রের খবর, পর্যটন কেন্দ্রের পাশাপাশি ওই জঙ্গি সাইবার কাফেতেও যায় বলে সন্দেহ। সেখান থেকেই বিভিন্ন ভাবে শাগরেদদের সে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠায়। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী, বেশির ভাগ ইন্টারনেট কাফেই গ্রাহকদের পরিচয়পত্র দেখতে চায়। কিন্তু ছদ্মবেশ নিতে পটু তেহসিনের হাতে সব সময়েই মজুদ থাকে উপযুক্ত ভুয়ো পরিচয়পত্রও। গোয়েন্দাদেরই একটি অংশ বলছে, পুলিশের চোখে যে ধুলো দেয়, ইন্টারনেট কাফের লোকজন তার কাছে তো নস্যি!
কেন এ কথা বলছেন তাঁরা? কারণ, পুলিশের একটি সূত্রই জানাচ্ছে, তেহসিনের ছবি ছিল বিহার প্রশাসনের কাছে। তা সত্ত্বেও সকলের নজর এড়িয়ে সে রাজধানী পটনায় নিশ্চিন্তে ঘুরে যায়। সমস্তিপুরের বাসিন্দা তেহসিনের খোঁজে ওই ছবি রাজ্যের সমস্ত জেলা প্রশাসন, ভারত-নেপাল সীমান্তে মোতায়েন বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, দেশ ছেড়ে তেহসিন যাতে পালাতে না-পারে, সে জন্য নেপাল সীমান্ত ‘সিল’ করা হয়েছে। পুলিশের একাংশের আশঙ্কা, নেপাল হয়ে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে পালানোর ছক কষতে পারে ওই জঙ্গি।
তেহসিনই অবশ্য একমাত্র মাথাব্যথা নয়। তার এক সঙ্গীর নামও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। সে হায়দর।
পটনা স্টেশনে বিস্ফোরকের রিমোটের ব্যাটারি বদলাতে গিয়ে বোমা ফেটে যায়। তাতে মারা যায় আইএম সদস্য এনুল। গাঁধী ময়দানে বিস্ফোরণের মূল দায়িত্ব ছিল যে দু’জনের উপরে, সে তার অন্যতম। তার সঙ্গী ছিল রাঁচির বাসিন্দা ইমতিয়াজ আনসারি। সে-ও গ্রেফতার হয়। তার পরেই তদন্তে উঠে এসেছে হায়দরের নাম। সে-ও রাঁচির যুবক। যদিও আদত বাড়ি বিহারের ঔরঙ্গাবাদে। বয়স বছর তিরিশ। ২০১০ সাল থেকে সে রাঁচির ডোরান্ডায় থাকত। রাঁচির এসএসপি সাকেতকুমার সিংহ জানিয়েছেন, ইয়াসিন ভটকল, মনজর ইমামের মতো শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পরে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সংগঠন ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে। তখন সংগঠনের কাজকর্ম তদারক করার দায়িত্ব নেয় তেহসিন। তার সঙ্গী হয় হায়দর। বারাণসী, মুম্বই, হায়দরাবাদে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে অন্যতম অভিযুক্ত তেহসিনের খোঁজ পেতে আগেই ১০ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পটনায় হামলার জন্য তিনটি দল তৈরি করেছিল তেহসিন, হায়দররা। ‘ক্যুরিয়র’ সদস্যদের দায়িত্ব ছিল, ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান করা। ‘ক্যারিয়র’রা বিস্ফোরকের সরঞ্জাম জোগাড় করে সেগুলি তৈরি করেছিল। বিস্ফোরকগুলি পৌঁছে দেওয়া হয় ইমতিয়াজদের মতো ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্কার’দের কাছে। ঝাড়খণ্ডের এক পুলিশকর্তা জানান, ইমতিয়াজ-সহ রাঁচির সিঠিও বস্তির চার জনকে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্কার’ হিসেবেই পটনায় পাঠিয়েছিল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। পুলিশের দাবি, ইমতিয়াজের বাড়িতে গিয়েছিল তেহসিনও।
কতটা নিপুণ ভাবে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ সেরেছিল তেহসিন-হায়দরের দলবল, সেটা বোঝা গিয়েছে এ দিনও। গাঁধী ময়দান থেকে আজও মিলেছে পাঁচটি তাজা বোমা, যেগুলি পায়ের চাপে ফেটে যেতে পারত। এই নিয়ে সব সমেত ১৮টি বোমার সন্ধান পেল বম্ব স্কোয়াড। সভার পরে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। তার পরেও যে ভাবে বোমা উদ্ধার হচ্ছে, তাতে যথেষ্ট চিন্তিত গোয়েন্দারা। তাঁদের একাংশ বলছে, নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করার পাশাপাশি তেহসিনরা সম্ভবত কম মাত্রার একাধিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সভায় হইচই ফেলে দিতে চেয়েছিল, যাতে দৌড়তে গিয়ে অন্তত কিছু মানুষ পদপিষ্ট হন। আতঙ্কের আবহ তৈরি হয় গোটা এলাকা জুড়ে।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, এ যাত্রায় বড় নাশকতা এড়ানো গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তেহসিন ও হায়দর যত দিন পালিয়ে বেড়াচ্ছে, বড় কোনও বিস্ফোরণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর তেহসিনকে পাকড়াও করা? পথ খুঁজতে আপাতত হিমসিম সকলে।
|