স্থান- সিউড়ির একটি হোটেল। সময়- দুপুর ১টা। বিজয়া সম্মিলনী ও ঈদ উপলক্ষে জেলার সাংবাদিকদের দেওয়া দাওয়াতে খোশমেজাজে মেতে উঠেছেন সাংসদ শতাব্দী রায়। শুরুতেই বাংলা চলচ্চিত্রের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বলে উঠলেন, “আজ কিন্তু আমরা নির্ভেজাল আড্ডায় মাতব!”
কাযর্ত বীরভূমে এখন রঙিন আড্ডার মেজাজেই মেতে রয়েছেন রাজ্যের শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। আর কেনই বা থাকবেন না? বিরোধী দলগুলির ছোটবড় সব নেতাই তো প্রায় তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। যে ক’জন বাকি রয়েছেন, তাঁরাও যে খুব বেশি দিন বিপক্ষ হয়ে বসে থাকবেন না, তার দাবি করছেন তৃণমূলের প্রায় সব নেতাই। ফলে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নেতৃত্বে দল যে বিপুল সাফল্য পেয়েছে, তারপরে নিজেদের মধ্যে বিবাদ অনেকটাই মিটিয়ে ফেলেছেন নানা গোষ্ঠীগুলিও। তবু অসন্তোষ যে পুরোপুরি মেটেনি তা-ও মাঝে মধ্যেই নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে ধরা পড়ছে। |
মঙ্গলবার দুবরাজপুরের কর্মিসভায় বক্তব্য রাখছেন তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়।—নিজস্ব চিত্র। |
এই পরিস্থিতিতে জেলার বিরোধী দলগুলো তবে সব গেল কোথায়! জেলার এক প্রবীণ রাজনীতিক ঠেঁস দিয়ে বললেন, “আসলে নদীর বাঁধ ভেঙেছে।” অনুব্রত-জমানায় জেলায় বিরোধী দলগুলির নেতা-কর্মীরা যে হারে দিদির খাতায় নাম লেখাচ্ছেন, তাকে এ ভাবেই বিশ্লেষণ করছেন তিনি। আদতে বিপ্লব ওঝা থেকে শুরু করে হাল আমলে পীযূষ পাণ্ডে, ধীরেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সবার ক্ষেত্রেই তৃণমূল এক ছকে এগিয়েছে। বিরোধীদের দাবি, তৃণমূলে যোগ দেওয়া এখন সন্তোষজনক একটি ‘প্যাকেজে’ পরিণত হয়েছে। ব্লক বা জেলা স্তরের কোনও নেতা দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দিলেই দলে বা কোনও লোভনীয় সরকারি পদ পেয়ে যাচ্ছেন।
এ দিকে বিরোধীদের এখন রাজনৈতিক কৌশলই দাঁড়িয়েছে যেন অপেক্ষা করা। জেলায় ইতিমধ্যেই লাল পার্টির দাপটের দিন ফুরিয়েছে। তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের একটা অংশ তৃণমূলে ঢুকে গিয়েছেন। বেশির ভাগ নেতাই এখন চুপচাপ ঘরেই রয়েছেন। জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অরুণ চৌধুরী অসুস্থ, বয়স হয়েছে জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়েরও। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের তেমন কোনও নেতাও তৈরি নেই। তার উপর অধিকাংশ পার্টি অফিস বন্ধ। দলীয় কর্মসূচিও নজরে পড়ার মতো নয়। আদর্শগত কারণে অতীতে যাঁরা দল ছেড়েছেন তাঁদের একটা বড় অংশেরই অভিযোগ, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিরোধী দল হিসেবে যে ভূমিকা পালন করা দরকার, বামেদের থেকে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। “নেতারা যেন পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছেন! তাঁরা যেন তৃণমূলে যোগ দেওয়া লোকেদের স্রোত কমার অপেক্ষায় রয়েছেন। ওই অপেক্ষা করতে করতে পার্টিটাই যে মাটি থেকে উপড়ে যাবে, তা তাঁরা ভাবছেন না!” ক্ষোভ ঝরে পড়ল সিপিএমেরই এক জেলা স্তরের নেতার। দিলীপবাবুর অবশ্য দাবি, “বীরভূম বিরোধীশূন্য হয়ে যায়নি। তৃণমূলের সন্ত্রাসে আমরা অনেক জায়গায় পার্টি অফিস খুলতে পারছি না। তবুও নিয়মিত কর্মসূচি করছি।” ভোটে খাতায় কিছু বোর্ড গড়লেও পঞ্চায়েতে জয়ী সদস্যেরা অনেকেই তৃণমূলে চলে যাওয়ায় তেমন দাগ কাটতে পারছে না বিজেপিও।
অন্য দিকে, তৃণমূলের ঝড়ে জেলায় কংগ্রেসও এখন চরম সঙ্কটে। একদা দাপুটে নেতা নীহার দত্তর হাত ধরে মূলত সাঁইথিয়াকে ‘বেস’ করে লাল মাটির এই দেশে কংগ্রেসের উত্থান। কিন্তু আজ পরিস্থিতি এমন যে, তাঁরই ছেলে অনুব্রত-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। নলহাটি, দুবরাজপুরের পরে সাঁইথিয়াও হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। এমনকী, তৃণমূল দাঁত বসিয়েছে কংগ্রেসের এত দিনের শক্ত ঘাঁটি মুরারইয়েও। তবে এই পরিস্থিতিতেও কম হুঙ্কার ছাড়ছেন না জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। তাঁর জোর দাবি, “ওরা প্রত্যকেই সুবিধাবাদী। প্রত্যেকের ক্ষমতা লোভও অসীম। তৃণমূল ওদের বেশি দিন সামলাতে পারবে না।”
সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া প্রদেশ কংগ্রেস সদস্য দেবাশিস সাহা, মল্লারপুরে এক সময়ের দাপুটে কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায়রা কিন্তু বলছেন, “জেলা কংগ্রেস নেতৃত্ব কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে। বিপদে তাঁরা কেউই পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। অথচ নিজেদের তাঁবেদারি ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন।” নীহার দত্তর ছেলে তথা সাঁইথিয়া পুরসভার কাউন্সিলর বিপ্লব দত্তর কথায়, “যুব কংগ্রেসের নেত্রী থাকার সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের হৃদয়ে ছিলেন, আজও আছেন। তাঁর প্রতি আস্থা রেখে এখন থেকে তাঁর সঙ্গেই পথ চলা শুরু করলাম।” সাঁইথিয়ায় দলের এত দিনের সংগঠক, তাঁরই দাদা সব্যসাচী দত্তেরও দল ছাড়াটা এখন সময়ের অপেক্ষা বলে দাবি করছে তৃণমূলেরই একটি অংশ। একই সঙ্গে দল ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন জেলার আইএনটিইউসি নেতৃত্বের একটা অংশও। আবার এমন ‘পরিবর্তনে’র দিনে বিরোধী দলের এক বিধায়ককে নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা। লোকসভা ভোটে তিনিও তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন বলেই একটি অংশ থেকে এখন থেকেই দাবি করা হচ্ছে।
বস্তুত, বীরভূমে এখন তৃণমূল দলে অনুব্রত মণ্ডলের কোনও বিকল্প কেউ নেই। দলে তাঁর প্রবল বিরোধীরাও বলতে শুরু করেছেন, “আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় রামপুরহাটে দলের তেমন ভাল ফল করতে পারেননি। সিউড়ি, নানুর ছাড়া স্বপনকান্তি ঘোষ ও গদাধর হাজরাদের কোনও গ্রহণ যোগ্যতাই নেই। আবার শতাব্দীর নেতৃত্বও কেউ মেনে নেবেন না। এই পরিস্থিতে তাঁর মতো দক্ষ সংগঠকের প্রতি আস্থা না দেখানোটা বোকামি।” এই পরিস্থিতিতে পুরনো মান অভিমান মিটিয়ে ফেলেছেন অনেককেই। অনুব্রতর সঙ্গেই একমঞ্চে খোশমেজাজে দেখা যাচ্ছে গদাধর হাজরা, আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূল সূত্রে খবর, পঞ্চায়েতগুলি ভাগাভাগি করে নিয়ে চালানোর ক্ষেত্রে রফা হয়ে গিয়েছে দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেও। দু’জনের কেউই মানতে না চাইলেও তৃণমূল নেতৃত্বের একটা বড় অংশই স্বীকার করে নিচ্ছেন, তৃণমূল সাংসদ আর জেলা সভাপতির একে অপরের প্রতি ক্ষোভ এখনও পুরোপুরি মেটেনি। তবে ক্ষত অনেকটাই সেরেছে। লোকসভা ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দু’জনেই ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছেন। কিন্তু বরফ ঠিক কতটা গলল কিংবা আদৌ গলল কিনা, তার উত্তর মিলবে ভবিষ্যতেই! |