খাতায় কলমে বর্ষা পার, কিন্তু নিম্নচাপের জেরে বৃষ্টি লেগেই রয়েছে। আবার কখনও দেখা মিলছে চড়া রোদের। প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনায় জেলা জুড়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে সব্জি, ফল ও ফুল চাষ। ফলন কতটা হবে, সেই চিন্তায় মাথায় হাত চাষিদের।
পূর্বস্থলীর দুই ব্লকে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সব্জি চাষ হয়। বাঁধাকপি, ফুলকপি, বিট, গাজর, পটল, মটরশুঁটি, ঝিঙে -সহ নানা সব্জি বাক্সবন্দি হয়ে পৌঁছে যায় হাওড়া, আসানসোল, দুর্গাপুরের বিভিন্ন বাজারে। কিন্তু গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পরে জমিতে পড়ে থেকে বহু গাছই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে চাষিদের দাবি। তাঁরা জানান, ঝিঙে, পটল, বরবটির মতো সব্জির পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। বহু জমিতে এখনও জল নামেনি। এ অবস্থায় মরা গাছ তুলে ফেলে নতুন চারা লাগাতে অন্তত সপ্তাহ দেড়েক সময় লাগবে। বড়গাছির এক চাষি গণপতি মাহাতো বলেন, “২২ কাঠা করে পাশাপাশি দুই জমিতে ১৩ হাজার ফুলকপির চারা লাগিয়েছি। একটি জমিতে সবে ফুলকপি ধরছে। অন্যটিতে চারার বয়স দিন পনেরো। কিন্তু বৃষ্টিতে জমিতে জল জমে সমস্ত চারা ঝিমিয়ে পড়েছে। জানি না কতটা ফলন পাব।” লঙ্কা চাষি গজানন সাহার দাবি, “অতি বৃষ্টিতে গাছের গোড়াপচা রোগ দেখা দিয়েছে। বারবার ওষুধ স্প্রে করেও সব্জি বাঁচাতে হিমসিম দশা। যা ফলন তাতে চাষের খরচও উঠছে না।” |
সব্জি ও ধান চাষে ক্ষতি হয়েছে কসবা মানা এলাকাতেও। এখান থেকে বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্তে সব্জি যায়। স্থানীয় চাষীদের মতে, প্রায় দুশো বিঘে মাঠে কাটা ধান নষ্ট হয়েছে। যেগুলি কাটা হয়নি তাদের গোড়ায় জল জমে পচতে শুরু করেছে। তবে সবথেকে ক্ষতি হয়েছে ফুলকপির। এলাকাজুড়ে প্রায় তিনশো বিঘে জমিতে ফুলকপির গোড়া পচে গিয়েছে। ফলে চাষের খরচের টাকাও ওঠেনি চাষিদের। এছাড়া বাদাম, লঙ্কা চাষেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় এক চাষী মনোজ সরকার এ বার প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন। তবে এক বিঘারও কম জমি থেকে ফুলকপি তুলতে পেরেছেন। জলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বিঘেখানেক জমির লঙ্কাও। তিনি বলেন, “সামনে আলুর মরসুম। কোথা থেকে টাকা জোগাড় করব জানি না।” দুশ্চিন্তায় এলাকার বীজ ব্যবসায়ী শেখর বিশ্বাসও। তিনি জানান, বেশিরভাগ লোকেই ফসল তোলার পরে বীজ, সার এসবের দাম দেন। কিন্তু এ বারে বৃষ্টিতে যা ক্ষতি হয়েছে তাতে চাষীরা কীভাবে টাকা মেটাবেন বুঝতে পারছি না। আবার টাকা না পেলে আলু চাষের জন্য বীজ আনতে যে অসুবিধায় পড়তে হবে সেকথাও তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন।
শীতের আগে এই বৃষ্টিতে বিপদে পড়েছেন ফুল চাষিরাও। পূর্বস্থলী ২ ব্লকের পূর্বস্থলী, পলাশফুলি, লক্ষ্মীপুর -সহ বিস্তীর্ণ এলাকার চাষিরা জানান, ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই জমি তৈরি করতে শুরু করেন তাঁরা। এরপরে ক্যালেন্ডুলা, ইনকা, জ্যাজিনা -সহ নানা ফুলের বীজ ফেলা হয় জমিতে। আশ্বিনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় চারাগাছ বিক্রি। চলে পৌষ মাস পর্যন্ত।
পলাশফুলির সব্জি চাষি মহাদেব দত্ত বলেন, “জমিতে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বীজ ফেলেও লাভ হয়নি। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া থাকায় ছাউনি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিজের চার বিঘা জমির জন্য চল্লিশ হাজার টাকার বীজ ফেলেছিলাম। সবটাই গেল।” পূর্বস্থলী ২ ব্লকের চাষিদের নিয়ে তৈরি পূর্বস্থলী নার্সারি ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি নিখিল শীলের কথায়, “সমিতির তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ক্ষতির বিষয়টি জেলা উদ্যান পালন দফতরের নজরে আনা হবে।” পূর্বস্থলী ১ ব্লকের হেমায়েতপুর, দক্ষিণ শ্রীরামপুর, চকরাহাতপুর, গঙ্গানন্দপুর, দোগাছিয়ার চাষিদের দাবি, নষ্ট হয়েছে পেয়ারা ও পেঁপে গাছও। মহকুমা কৃষি দফতরের সহ -কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “নিচু এলাকাগুলিতে বেশ কিছু দিন জল জমে থাকায় বহু পেঁপে এবং পেয়ারা গাছের গোড়া পচে গিয়েছে।”
মঙ্গলবার জেলা উদ্যান পালন আধিকারিক সজলেন্দু শীট বলেন, “প্রথমে সব্জি, ফুল, পেয়ারা, কলা, পেঁপে চাষে কত শতাংশ ক্ষতি হয়েছিল তার একটি প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল। তবে আমাদের কাছে দুর্যোগ মোকাবিলা দফতরের নতুন নির্দেশিকা এসেছে। তাতে ক্ষতির পরিমাণ নতুন ভাবে হিসেব করতে হবে। তারপরে রিপোর্টটি জেলাশাসকের কাছে জমা দেওয়া হবে।” জেলা উদ্যান পালন দফতর সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, কেতুগ্রাম ১, ২ এবং মঙ্গলকোটের বহু চাষি এ বার বিকল্প চাষ হিসেবে উঁচু জমিতে পেঁপের চাষ করেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে লাভের মুখ দেখেননি তাঁরা। আউশগ্রাম ১ ও ২ ব্লকে মার খেয়েছে কলা চাষ। গলসি, কালনা ১ ও ২, বর্ধমান ১ ও ২ ব্লকেও ক্ষতি হয়েছে কলা, পেয়ারা, পেঁপে চাষের। |