|
|
|
|
বাই বাই ব্ল্যাকবেরি
অ্যাপেল, স্যামসাং-য়ের দাপটে কি চিরনিদ্রায় ব্ল্যাকবেরি? লিখছেন কল্যাণ কর। |
এ বারের লেখাটা আমি তিনটে ক্যুইজ কোয়েশ্চেন দিয়ে শুরু করব। যদি আপনি ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেন, তা হলে এই লেখাটা আপনার না পড়লেও চলবে!
প্রথম প্রশ্ন এই পৃথিবীতে জনসংখ্যার নিরীখে প্রথম তিনটে নাম বলুন। ভাবছেন এ আর কী প্রশ্ন! আপনার স্কুলে পড়া ভাইপো জানে। ঠিক ধরেছেন, সে জানে। তবে আপনি বোধহয় জানেন না। চীন, ভারত এবং আমেরিকা? হল না, হল না। প্রশ্নটা আবার পড়ুন। আমি কিন্তু ‘দেশ’ বলিনি...পারলেন না তো? উত্তর চীন, ভারত এবং ফেসবুক। হ্যাঁ, ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা একশো কোটির ওপর, যেখানে আমেরিকা তিরিশ কোটির আশেপাশে! হ্যাঁ, ফেসবুক যদি একটা দেশ হত, তা হলে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হতে পারত। একদম দাদার বাপি বাড়ি যা, তাই না?
এই বার দ্বিতীয় প্রশ্ন এটা শেন ওয়ার্নের গুগলি!
পৃথিবীর এক নম্বর ক্যামেরা কোম্পানির নাম বলুন। কী ভাবছেন? কোডাক, মিনোল্টা, ক্যানন? হল না, হল না। কোম্পানির নাম নোকিয়া। সৌজন্যে ক্যামেরা লাগানো মোবাইল ফোন। ২০০৮ সালে সব চেয়ে বেশি ক্যামেরা বিক্রি করে নোকিয়া পৃথিবীর এক নম্বর ক্যামেরা কোম্পানি হয়ে ওঠে পৃথিবী জুড়ে মোবাইল ফোন বিক্রি করে।
সব শেষে তৃতীয় প্রশ্ন এই বারে হরভজনের দুসরা!
ভারতের এক নম্বর মিউজিক কোম্পানির নাম বলুন। এই বারে আপনি নিশ্চয়ই আরেকটু সজাগ হয়েছেন? একটু ‘হটকে’ ভাবছেন? চেষ্টা করুন, চেষ্টা করুন। বলে দেব? এয়ারটেল। ইয়েস স্যর, ২০০৯ সালে এয়ারটেল-এর মিউজিক রেভিনিউ বাকি মিউজিক কোম্পানিদের টপকে যায়। সৌজন্যে মোবাইল ফোনে আপনাদের গান ডাউনলোড করা।
উপরের তিনটে উত্তরের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পেয়েছেন? সেটা হল ‘প্রযুক্তি’ এবং তার সঙ্গে ‘উদ্ভাবন’। হ্যাঁ, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন এই পৃথিবীকে একটা নতুন মাত্রা দিতে চলেছে। মনে রাখবেন সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, অ্যানালিটিক্স এবং ক্লাউড কম্পিউটিং এই চার প্রযুক্তির বিপ্লব আমাদের জীবন যাপন পুরো পালটে দিয়েছে। সংক্ষেপে বিশেষজ্ঞরা একে বলে ‘এসএমএসি (স্ম্যাক)’।
এবং এখানেই আসল গল্প। কিছু দিন আগে সারা পৃথিবীর সেরা ব্র্যান্ডের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রথম দশটা কোম্পানির মাঝে এমন তিনটে নাম যারা কিনা প্রযুক্তিনির্ভর এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতায় সবাইকে টেক্কা দিতে চলেছে আগামী দিনে। অ্যাপল, গুগল এবং স্যামসাং। হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী দিনে ‘প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন’ হল বাজিমাত করার সেরা রসায়ন এবং সেখানেই এই তিন সংস্থা তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে বাকিদের পিছনে ফেলে। ঠিক যেমন সচিন, সৌরভ এবং দ্রাবিড় ক্রিকেট দুনিয়া মাতিয়ে রাখত এক সময়। এক বাক্যে ক্রিকেট দুনিয়া বলত এই রকম ‘ক্লাস-স্টাইল-টেকনিক’ আর কোথাও নেই। ঠিক সে রকমই আমাদের অ্যাপল, গুগল আর স্যামসাং।
একটা গল্প মনে পড়ছে। সাল ১৯৮৩। অ্যাপলের স্রস্টা এবং উদ্ভাবনীর জাদুকর স্টিভ জোবস খুঁজছিলেন এমন একজনকে যে মার্কেটিংয়ের জাদু দিয়ে সারা বিশ্বে অ্যাপলকে ছড়িয়ে দিতে পারবে। চোখ পড়ল জন স্কালির উপরেই। জন তখন একটি বহুজাতিক ঠান্ডা পানীয় সংস্থার প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকার টপ এক্সিকিউটিভদের মধ্যে একজন। কিন্তু জন কিছুতেই রাজি নয় অ্যাপল জয়েন করতে। অনেক বার কথা বলেও স্টিভ জোবস ব্যর্থ হলেন। কেনই বা জন তাঁর এত বড় পজিশন ছেড়ে, এত বড় কোম্পানি ছেড়ে, এত টাকার কাজ ছেড়ে নতুন, নাম না জানা একটি সংস্থায় যোগ দেবেন! স্টিভ একটি শেষ চেষ্টা করার জন্য জনকে একদিন রিকোয়েস্ট করলেন “তুমি শেষ বারের মতো এক বার আমার সঙ্গে দেখা করো। তার পর তোমার সিদ্ধান্তই শেষ কথা।” নিমরাজি জন দেখা করলেন স্টিভের সঙ্গে। আর তখনই জন্ম নিল সেই অসাধারণ বাণী যা আজও অমর হয়ে আছে, “জন, তুমি কি বাকি জীবন মিষ্টি জল বিক্রি করে কাটাবে নাকি আমার সঙ্গে দুনিয়া পালটাবার চেষ্টা করবে?” (ডু ইউ ওয়ান্ট টু সেল সুগারড ওয়াটার ফর দ্য রেস্ট অফ ইয়োর লাইফ? অর ডু ইউ ওয়ান্ট টু কাম উইথ মি অ্যান্ড চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড?”)...এর পর জনের আর কিছু বলার ছিল না। জন এবং স্টিভ এর পর প্রচুর ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং আজও অ্যাপল অহরহ দুনিয়া পালটে চলেছে। আচ্ছা, আপনারা কি জানেন, এই তিন সংস্থা ধারে এবং ভারে কী রকম শক্তিশালী?
নীচে কিছু পরিসংখ্যান দিলাম আপনাদের বোঝার জন্য— |
|
অ্যাপল |
গুগল |
স্যামসাং |
সংস্থার বয়স বছরে |
৩৭ |
১৫ |
৪৪ |
গতবছরের বিক্রয় (লক্ষ-কোটিতে) |
১০ |
৩ |
১১ |
গত বছরের মুনাফা |
২.৫ |
০.৬৫ |
১.৪ |
সংস্থার সম্পদ |
১১ |
৬ |
১০ |
কর্মী সংখ্যা সারা বিশ্বে |
৮০০০০ |
৪৫০০০ |
২,২২,০০০ |
|
সংখ্যাগুলো নিশ্চয়ই চমকে দেওয়ার মতো? তা হলে আরও চমকে দেওয়া যাক যদি বলি এই সংস্থাগুলো কিছু দেশের থেকেও ধনী, বিশ্বাস করবেন না তো? তা হলে শুনুন, যে কোনও দেশ কত ধনী তা হিসেব করা হয় গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) দিয়ে। নিউজিল্যান্ডের জিডিপি হচ্ছে প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা...আজ্ঞে হ্যা। স্যামসাং সংস্থাটি নিউজিল্যান্ড দেশের থেকেও ধনী। বাংলাদেশ হচ্ছে ৬ লক্ষ কোটি। অর্থাৎ গুগল বাংলাদেশের সমান। পাকিস্তান আর অ্যাপল প্রায় কাঁধে কাঁধে। কল্পনা করতে পারছেন এদের আর্থিক শক্তি? আমাদের দেশ, যাকে কিনা পৃথিবীর বৃহৎ দেশের মধ্যে গণ্য করা হয়, আমাদের জিডিপি প্রায় ১২০ লক্ষ কোটি টাকার মতো। এই তিন জন মিলে ২৭ লক্ষ কোটি, অর্থাৎ আমাদের পুরো দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশের একটু বেশি। এরা তিন জন একজোট হলে পৃথিবীর পঁচিশতম ধনী দেশ হতে পারত। এর মানে এই জোট পৃথিবীর প্রায় ১৭০টা দেশের থেকে বেশি ধনী। এই বারে আমি নিশ্চিত আপনার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। এই পরিসংখ্যানের সামনে আমাদের আসন্ন লোকসভার যে কোনও জোট পুরো ফিকে লাগছে না?
এ বার প্রশ্ন হল এরা এত অতিকায়, এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠল কী করে? আগেই বলেছি এর একটাই কারণ। প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা। পুরনো দিনের ব্যবসায়িক ধ্যান-ধারণা এখন অচল হয়ে গিয়েছে এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, মানুষের চাহিদা অনুমান করে এরা কয়েক কদম এগিয়ে থাকতে পেরেছে। লক্ষ করে দেখুন, এদের বয়স কিন্তু খুব বেশি নয়। পোড় খাওয়া মধ্য বয়স্ক স্যামসাং অনেক লড়াই লড়ে আজ রাহুল দ্রাবিড়ের মতো তার ‘টেম্পারামেন্ট অ্যান্ড টেকনিক’-এ ভর করে বাজার মাত করে দিচ্ছে। মনে করুন অ্যাপল চিরকাল সৌরভের মতো স্টাইলিশ। যাই করবে, তাতে শিল্পের ছোঁয়া লেগে থাকে। আবাল বৃদ্ধবণিতা তার জন্য ফিদা। আর সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিতে যাওয়া গুগল হল আমাদের সচিন। ট্যালেন্ট যেন উপচে পড়ছে!
উদ্ভাবন কেন এত জরুরি? আপনারা কি জানেন, আমেরিকার ৫০% জিডিপি গ্রোথ উদ্ভাবনের জন্য? খেয়াল করে দেখবেন, যে দেশ যত বেশি উদ্ভাবন করার ক্ষমতা রাখে, সেই দেশ তত অগ্রগতি করছে। এবং আমেরিকা তার শীর্ষে। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা বুঝে এবং অন্যের থেকে আগে ভাগে উদ্ভাবন করে বাজার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকার কৌশল যে যত ভাল রপ্ত করতে পারবে... জিৎ তারই হবে। এইখানেই আমাদের ওই তিন সংস্থা অনেকের থেকে এগিয়ে। ব্ল্যাকবেরি একটা অসাধারণ উদাহরণ। স্মার্টফোনের পথিকৃৎ হল ব্ল্যাকবেরি। ২০০৩ সালে লঞ্চ করার পর থেকে ব্ল্যাকবেরির জয়জয়াকার সর্বত্র। যে কোনও কর্পোরেট হাউস তখন লাইন দিয়ে ব্ল্যাকবেরি কিনছে। প্রত্যেক হাইফ্লাইং এক্সিকিউটিভের কোমরে ঝুলছে ব্ল্যাকবেরি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে আপনি যে কোনও সময়ে ‘কানেকটেড’। ই-মেল পাচ্ছেন, পড়ছেন, রিপ্লাই দিচ্ছেন...নিমেষের মধ্যে ‘কমিউনিকেশন এবং ডিসিশন’ টুল হিসেবে তখন ব্ল্যাকবেরির জুরি মেলা ভার। কিন্তু আজ দেখুন, সেই স্মার্টফোন লড়াইয়ে তারা কোথায় পিছিয়ে পড়েছে এর একটি কারণ, সময় যত গড়িয়েছে, কম্পিটিটররা ততই মার্কেট বোঝার চেষ্টা করছে এবং সুযোগ বুঝে চাহিদা সৃষ্টিও করেছে। কখন যে সবাই ব্ল্যাকবেরিকে টপকে চলে গিয়েছে কেউ বুঝতেই পারেনি। |
কেন অ্যাপেল-সামসাং |
ব্ল্যাকবেরি-র সমস্যা কোথায় |
• উদ্ভাবন। নতুন নতুন অ্যাপসের সৃষ্টি
• স্টাইলিশ। পুরনো ওয়েবপেজ-ও নতুন মোড়কে
• ফাস্ট। মাল্টি-টাস্কিং সহজে
• বিবিএম এখন আই ও-এস, অ্যান্ড্রয়েডেও |
• উদ্ভাবনের অভাব। বিবি ১০-ও খুশি করতে পারেনি
• একই ইউজার ইন্টারফেস-এ মন ভরছে না জেন ওয়াইয়ের
• স্লো প্রোসেসর। ব্যাটারির আয়ু কম
• হোয়াটস্অ্যাপ এসে বিবিএম আরও গত |
|
আজ নিজের তৈরি করা স্মার্টফোন-বাজারে ব্ল্যাকবেরি অনেক পেছনের সারিতে। এর একটি কারণ চমক দেখিয়ে শুরু করেও উদ্ভাবনী ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি ব্ল্যাকবেরি। তবে ব্ল্যাকবেরি প্রেমীদের জন্য সুখবর— সব আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। খুব সম্ভবত তিরিশ হাজার কোটি টাকা দিয়ে কানাডার ফেয়ারফ্যাক্স সংস্থা ব্ল্যাকবেরি কিনে নিতে চলেছে। নেপথ্য নায়ক এক অনাবাসী ভারতীয়, প্রেম ওয়াতসা। দেখা যাক ব্ল্যাকবেরি তার হারানো গৌরব ফিরে পায় কি না- আমরা সবাই আশায় রইলাম।
এখানেই শেষ নয়। এই অতি আশ্চর্য পৃথিবীতে এটাই নিয়ম। প্রচুর সুযোগ। কিন্তু প্রতিদিন একটা নতুন দিন। আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই। আফ্রিকার সেই সিংহটার মতো, যাকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে বলতে হয় আমাকে আজ সব থেকে ধীর গতির গ্যাজেলের থেকে জোরে দৌড়াতে হবে। না হলে আমি না খেতে পেয়ে মারা যাব।
অর্থাৎ, হে অ্যাপল, স্যামসাং আর গুগল মহোদয়গণ, “ওয়েক আপ, গেট আপ অ্যান্ড রান” কারণ বাকিরা খুব পেছনে নেই। মনে রাখবেন টানা
কুড়ি বছর আমেরিকার ধনীদের শীর্ষে থাকা একজন মিস্টার বিল গেটস, তাঁর সৃষ্টি করা মাইক্রোসফ্টের সঙ্গে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মোবাইল ফোন কোম্পানি নোকিয়াকে মিশিয়ে দিয়েছেন কিছুদিন আগেই।
সাবধান। পৃথিবীর মানুষ আর একটা প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনীর বিস্ফোরণ দেখল বলে। |
|
|
|
|
|