নিঃশব্দ বিপ্লব
আনন্দplus
ভারতীয় টেলিভিশনে ‘টোয়েন্টি ফোর’ লঞ্চ হওয়ার আগে যে ক’টা সাক্ষাৎকার অনিল কপূর দিয়েছিলেন, তাতে একটা কথা সাফ বলে দিয়েছিলেন তিনি।
রিস্ক নিচ্ছেন ঠিকই, তবে তিনি নিশ্চিত যে ‘টোয়েন্টি ফোর’ করে তিনি ভারতীয় টেলিভিশন প্রোগ্রামিংয়ে আমূল পরিবর্তন আনতে পারবেন।
৪ অক্টোবর ভারতীয় টিভির পরদায় প্রথম বার অনিল কপূর অ্যান্টি-টেররিস্ট এজেন্ট জয় সিংহ রাঠোরের ভূমিকায়। মূল আমেরিকান টেলিভিশন সিরিজে তাঁর চরিত্রের নাম ছিল জ্যাক বয়ার। এক দৃশ্যে স্ত্রী-র জন্মদিন পালন করছেন তো অন্য দৃশ্যে চেষ্টা করছেন কী ভাবে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদপ্রার্থী এক ক্যান্ডিডেটকে আততায়ীর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। আর তা করতে গিয়েই হঠাৎ আবিষ্কার করেন তাঁর মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। গল্প যত এগোয়, ততই নতুন সব বাঁক নিতে থাকে।
একটা গিমিকই রিয়েল টাইম সেটিং। এক ঘণ্টার পর্ব জুড়ে একটা ডিজিটাল ঘড়ি টিক টিক করে চলে।
কিন্তু টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট)? থুড়ি এখন তো আর টিআরপি বলা হয় না। নতুন প্যারামিটার হল টিভিটি, ওরফে টেলিভিশন ভিউয়ারশিপ ইন থাউজ্যান্ডস।
টিভিটি কী বলছে?
সত্যি কি অনিল কপূরের জয় সিংহ রাঠোর পারছে টেলিভিশন ভিউয়ারশিপ গণনার কাঁটাটাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে?
ট্যাম রেকর্ড থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী প্রথম সপ্তাহে ‘টোয়েন্টি ফোর’ পেয়েছিল ৩১৩৪ টিভিটি। ওই একই চ্যানেলে রাত এগারোটার সময় সম্প্রচারিত হয় ‘কমেডি নাইটস উইথ কপিল’। ওই একই সপ্তাহে ওই শো-টি পেয়েছিল ৪৪৬২ টিভিটি। সোনি চ্যানেলের ‘সিআইডি’ সেই সপ্তাহে পেয়েছিল ৭০৪৮ টিভিটি।
তবে যাঁরা ‘টোয়েন্টি ফোর’ দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে এত তাড়াতাড়ি বিশাল একটা ফারাক প্রত্যাশা করাটাও ঠিক নয়। যে দর্শক এত দিন শুধুমাত্র শাশুড়ি-বৌয়ের কেচ্ছা বা সেলিব্রিটিদের ঝগড়া দেখার পর মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে ঘুমোতে গিয়েছেন, তাঁরা রাতারাতি সব কিছু উলটে দেখুন পালটে গিয়েছি করার বান্দা নন। যদিও ‘টোয়েন্টি ফোর’ আর ‘সিআইডি’ দু’টোই থ্রিলার ফরম্যাটের শো। তবু দু’টো বানানোর পদ্ধতির ভেতর বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়াও ১৬ বছর ধরে ‘সিআইডি’ দেখে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। সেখানে ‘টোয়েন্টি ফোর’-এর বয়স এখনও এক মাসও হয়নি। সাধারণ দর্শক তো এখনও ‘টোয়েন্টি ফোর’ নামটার সঙ্গেই পরিচিত নন। এই নামটার সঙ্গে ২৪ ঘণ্টার কী সম্পর্ক, সেটাও তো এখনও বুঝে উঠতে পারেনি।

শো-এর পরিচালক অভিনয় দেও। এর আগে পরিচালনা করেছিলেন ‘দিল্লি বেলি’র মতো সফল সিনেমা। বলছেন, “এই সিরিজটা বানানোর আগে আমরা অনেক গবেষণা করেছি। তখন বুঝতে পারি যে ট্যাম মিটারগুলো ভারতে মাত্র ৮০০০টা বাড়িতে লাগানো রয়েছে। আমাদের দেশে ৬০ কোটি মানুষ টেলিভিশন দেখেন। তার মধ্যে ট্যাম মিটার লাগানো বাড়ির সংখ্যা মাত্র ৮০০০। যদি এর আগের সমীক্ষাগুলো স্টাডি করা যায়, তা হলে বোঝা যাবে যে আশি লক্ষ লোক যদি সিরিজটা দেখেন, তা হলেই ভাল রেটিং পাওয়া যায়। আমার দৃঢ় ধারণা যে এই সংখ্যক মানুষ নিশ্চয়ই আমাদের শো-টা দেখেছেন। কিন্তু ট্যাম মিটারগুলো যেহেতু সেই সব মানুষের বাড়িতে নেই, তাই সেটা সার্ভেতে বোঝা যাচ্ছে না।”
শোয়ের কার্যনির্বাহী বাঙালি প্রযোজক অপূর্ব সেনগুপ্ত বলছেন, তাঁর কানেও এই ধরনের কথা এসেছে। “আমার মনে হয় যে দর্শকেরা আমাদের শো-টা দেখছেন তাঁদের ভিউয়ারশিপটা ট্যাম রেটিংয়ে ধরা পড়ছে না। তবে এটাও বলব যে ‘টোয়েন্টি ফোর’ এমন সব দর্শককে টিভি দেখতে বাধ্য করছে যারা আগে হয়তো কোনও হিন্দি চ্যানেলে সিরিয়াল দেখতেন না। এই দর্শকদের সংখ্যাটা টিভিটি-তে রিফ্লেক্টেড হলে দৃশ্যটা পালটিয়ে যাবে।”
শুধু যে ‘সংখ্যা’য় রিফ্লেক্টেড হচ্ছে না তা নয়। অনেকেই যাঁরা এই শোটি প্রথম দেখছেন, বলছেন যে ‘টোয়েন্টি ফোর’ এমন ভাবে তৈরি যা ভারতীয় দর্শকের কাছে একদম নতুন। গল্প লেখার আগে অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াডের প্রধান রাকেশ মারিয়া দেখা করেছেন অনিল কপূর আর অভিনয় দেও-য়ের সঙ্গে। তাঁর দপ্তরের একজনকে ‘টিম টোয়েন্টি ফোর’য়ের সঙ্গে দিয়েও দিয়েছিলেন যাতে কোনও দরকারে সাহায্যে আসেন। “প্রথম দিকের একটা এপিসোডে অনুপম খেরের এক ইনফর্মারের সঙ্গে দেখা হয়। আমরা ঠিক করেছিলাম দৃশ্যটা শ্যুট করব কোনও নিরালা জায়গায়। কিন্তু ওই ভদ্রলোক বলেন যে বাস্তবে এই ধরনের ইনফর্মারদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁরা সব সময় পাবলিক প্লেসে দেখা করেন। যাতে ইনফরমার কোনও বেগতিক কিছু না-করতে পারে। তাই ঠিক হয়, দেখা করার জায়গা হবে লেট নাইট শো দেখানো হয় এমন থিয়েটারে। এতে অথেন্টিসিটি বাড়ে।”

আদিত্য ও নয়না সিঙ্ঘানিয়ার চরিত্রের সঙ্গে দর্শক গাঁধী পরিবারের মিল পেয়েছেন।
অথেন্টিক হওয়ার সমস্যাও অনেক। জনপ্রিয় সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা তো ভোর ছ’টার সময়ও লাল লিপস্টিক পরে বাড়িতে ঘুরে বেড়ান। এই সিরিজে সেখানে মন্দিরা বেদী-র মেক আপটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। জামাকাপড়েও তেমন বদল নেই। অন্যান্য চরিত্রদের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। পরিচালক বলছেন এটা তো ইচ্ছে করেই করা হয়েছে। “এক রাতে এই ধরনের একটা অপারেশন হলে তখন কারও মেক আপ ঠিকঠাক থাকে নাকি? এটাই তো স্বাভাবিক,” অভিনয় বলছেন।
তবে বয়স্ক কিছু দর্শক এপিসোডগুলো দেখে বলেছেন তাঁরা নাকি মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। একই সঙ্গে চার-পাঁচটা ট্র্যাক চলতে শুরু করে। হঠাৎ করে স্ক্রিনটা চারটে ভাগ হয়ে যায়। প্রত্যেকটি ভাগে গল্পের এক একটা সাবপ্লটে কী ঘটছে তা দেখানো হয় একই সঙ্গে। ভারতীয় টেলিভিশনে তো এ রকম কাজ আগে কখনও হয়নি। একটা জন্মদিনের আসরে কী হচ্ছে তা দেখাতেই তো এ দেশের সিরিয়ালের গোটা একটা সপ্তাহ চলে যায়। মূল চরিত্র তাঁর মনের কথা আদৌ বলে উঠতে পারবে কি না, তা দেখাতে কেটে যায় কয়েক সপ্তাহ। আর সেখানে ‘টোয়েন্টি ফোর’য়ের ট্র্যাক ছুটে চলে তীব্র গতিতে। এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে বেশ মনোযোগ দিয়ে সিরিজটা দেখতে হয়। সব সময় সতর্ক। এই বুঝি নতুন কিছু ঘটে গেল। এই বুঝি অনিল কপূরের ব্লুটুথে এমন কোনও মেসেজ এল, যা গল্পের মোড়টাই ঘুরিয়ে দেবে। একটু চোখ সরালেই গেল। অনিল কপূর ঠিক কী বলে মন্দিরা বেদী-র বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে গুলি চালিয়েছিলেন সেটা যদি মিস করে যান তা হলে কিন্তু থ্রিলারের আসল মজাটাই খানিকটা পানসে হয়ে যাবে।
তবে অভিনয় বলছেন যে, তিনি কোনও ভাবেই শো-য়ের গতিটা কমাতে চান না। “প্রথমে বলা হয়েছিল যে, আমি যদি কিছু ট্র্যাকের সংখ্যা কমিয়ে দিই। কিন্তু আমার কথা হল হয় এভাবেই সিরিজটা বানাব না হয় বানাবই না। যদি হঠাৎ গতিটা কমিয়ে দিই, তা হলে যাঁরা ওরিজিনাল ‘টোয়েন্টি ফোর’ দেখেছেন তাঁরা বলবেন হচ্ছেটা কী? সেটা করলে তো ওই দর্শকদেরও আমরা হারাব। আমি জানি যে একটা এপিসোডে আমরা যা দেখাচ্ছি সেটা হয়তো অন্য সিরিয়ালে গোটা একটা মাস ধরে দেখানো হয়। সেটাই আমাদের ইউএসপি।”
শুধু যে জয় সিংহ রাঠোরের গল্প বলার ধরনের নতুনত্ব রয়েছে, তা নয়। তার সঙ্গে নিপুণ ভাবে, খানিকটা হয়তো কৌশল করেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের একটা ট্র্যাকও। ভারতীয় রাজনীতি গভীর ভাবে ফলো না করলেও বুঝতে অসুবিধা হবে না সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের সঙ্গে গাঁধী পরিবারের কী মিল। আদিত্য সিংঘানিয়ার চরিত্রে নীল ভুপালামের চেহারা আর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে তো ইতিমধ্যেই অনেকে প্রশ্ন করছেন যে তিনি রাহুল গাঁধীর দ্বৈতসত্তার ভূমিকায় অভিনয় করছেন কি না। বছর ঊনত্রিশের এক দর্শক তো বলেই ফেলেন, “প্রথম বার দেখেই বুঝলাম যে, নয়না সিঙ্ঘানিয়া (মানে অনিতা রাজ)য়ের যে চরিত্রের সঙ্গে সোনিয়া গাঁধীর বেশ খানিকটা মিল রয়েছে। নয়নার স্বামীও ছিলেন রাজনীতিবিদ। স্বামী মারা গিয়েছেন। এখন তাঁর লক্ষ্য ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আর তার জন্য যা করা দরকার তা-ই তিনি করছেন। এমনকী ছেলেকে পাখি পড়ানোর মতো করে বলে দিয়ে যান, কী কী করা উচিত। কোন র্যালিতে গিয়ে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের কোন ঘটনাটা বলা উচিত নয়, সেটাও বার বার মনে করিয়ে দেন। নাম যতই পালটাক এই ট্র্যাকে গাঁধী পরিবারের কথাই বলা হচ্ছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি।” জয় সিংহ রাঠোর সম্পর্কে এই ধরনের দর্শকের তত আগ্রহ না থাকলেও সিঙ্ঘানিয়া পরিবারে কী হচ্ছে তা জানার আগ্রহ কম নেই।

গল্প লেখার আগে অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াডের প্রধান রাকেশ মারিয়া নিজে দেখা করেছেন আমাদের সঙ্গে
এক বছর আগে এই সিরিজের স্ক্রিপ্টটা লিখেছি। শ্যুটিং শুরু হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে।
আমি নিজে বারোটা এপিসোড লিখেছি। তাই জানি এটা বলা ঠিক নয় যে, আমরা প্ল্যান করে
কোনও বিশেষ পরিবারের সঙ্গে মিল রেখে ট্র্যাকটা সাজিয়েছি
ভবানী আয়ার এবং আরও তিনজন মিলে ‘টোয়েন্টি ফোর’য়ের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। ভবানী এর আগে লিখেছিলেন ‘ব্ল্যাক’, ‘গুজারিশ’ আর ‘লুটেরা’। বলছেন, “এক বছর আগে এই সিরিজের স্ক্রিপ্টটা লিখেছি। শ্যুটিং শুরু হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। আমি নিজে বারোটা এপিসোড লিখেছি। তাই জানি এটা বলা ঠিক নয় যে, আমরা প্ল্যান করে কোনও বিশেষ পরিবারের সঙ্গে মিল রেখে ট্র্যাকটা সাজিয়েছি। অনেক সময় ফিকশনের সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকে। এ ছাড়া দর্শকেরও ইচ্ছে থাকে যাতে তাঁরা কোনও চরিত্র দেখেই তাঁদের স্পট করতে পারেন। সিরিজটা যত এগোবে, ততই দেখবেন গল্পটা কত পালটে যাচ্ছে।”
অভিনয় আরও বলছেন, “দর্শক তো না হয় গাঁধী পরিবারের সঙ্গে সিঙ্ঘানিয়া পরিবারের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু রাকেশ মারিয়া তো গল্পটা শুনে হাসতে হাসতে আমাদের বললেন যে জয় সিংহ রাঠোরের চরিত্রের সঙ্গে ওঁর নিজের জীবনেরও অনেক মিল রয়েছে! অবশ্য কী মিল, তা উনি বলেননি।”
তবে যেটা সব থেকে সুবিধে হয়েছে, সেটা হল অনিল কপূরের মতো একজন বড় তারকা এই ধরনের একটি শো-য়ের প্রযোজনা করছেন। শেষ কথা বললেন ‘টোয়েন্টি ফোর’-এর পরিচালক। মনে করিয়ে দিলেন কিছু বছর আগে ‘জোশ’ বলে একটা সিরিয়াল হত। প্রচুর খরচা করা হয়েছিল সেখানে। তবে কিছু দিন পর সেটা বন্ধও করে দেওয়া হয়। “আমাদের সুবিধে হল যে আমরা জানি এই সিরিজটা ২৪টা পর্বের পরেই শেষ হয়ে যাবে। তবে যে যাই বলুক, আমার মনে হয় ‘টোয়েন্টি ফোর’ একেবারেই পাথব্রেকিং একটা কাজ। একটা সময় হিন্দি সিনেমার খুব খারাপ দশা ছিল। তারকারাও বেশ বাজে সিনেমা করছিলেন। তার পর ‘দিল চাহতা হ্যায়’ আর ‘লগান’ এসে আমূল পরিবর্তন করে দিল সব কিছুর। পাঁচ-ছ’বছর যেতে দিন। দর্শকরা ভারতীয় টেলিভিশনে এই ধরনের কনটেন্টই দেখতে চাইবে।”
ভারতীয় দর্শক অপেক্ষায় রইলেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.