প্রবন্ধ ২...
পাহাড় একটা সুযোগ দিতে চায়, নিতেও
বিবারের দুপুর। ২০ অক্টোবর। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি। হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। ম্যালের বেঞ্চে চা খেতে-খেতে আড্ডা মারছেন জনা কয়েক ঘোড়াচালক আর আশপাশের দোকানি। প্রায় ফাঁকা ম্যালের দিকে আঙুল দেখিয়ে তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘পুজোর ছুটি, রবিবার, আর দার্জিলিঙের এই অবস্থা! হোটেলে ফিফটি পারসেন্ট ছাড় দিয়েও ট্যুরিস্ট নেই। ভরা মরসুমে এই ক্ষতি কী করে সামলাব জানি না। এ বার না-খেয়ে মরতে হবে।’ বহু ডাকাডাকি করেও ঘোড়ায় চড়ার লোক মিলছে না। ভরা মরসুমে যেখানে দিনে ঘোড়াওয়ালাদের ১৭০০-২০০০ টাকা রোজগার হয় সেখানে ১০০০ টাকা ওঠাতে কালঘাম ছুটছে। কিউরিয়ো শপ, চায়ের শোরুম মাছি তাড়াচ্ছে, গ্লেনারিজ কেভেন্টার্সে অনায়াসে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে!
হোটেল মালিক নারায়ণ ছেত্রী, ভাড়াগাড়ির চালক পুনিত পাখরিং, গার্ডের কাজ করা হরি জিমরে, উল-স্টলের মালিক শীতল তামাং, সেন্ট জোসেফের ছাত্রী রিঞ্চে দোং, বেকারি-মালিক গৌতম ত্রিবেদী, সিংমারি এলাকার গৃহবধূ অনুভা বমজানের মতো অনেকের সঙ্গে আলাদা-আলাদা ভাবে কথা হয়েছিল। যেন একে অন্যের প্রতিধ্বনি করলেন তাঁরা: ‘জ্যোতিবাবুকে দেখে প্রথম-প্রথম দার্জিলিং খুব ভরসা পেয়েছিল। একটা সময় সেই আশা ভাঙতে শুরু করল। তার পর ধূমকেতূর আবির্ভাব। সুবাস ঘিসিং। প্রায় কুড়ি বছর ওঁকে সময় দিয়েছিলেন মানুষ। কত লোক জান দিল। তখন দার্জিলিংয়ের উন্নয়নে নাকি অনেক টাকা এসেছিল? কোথায় গেল সে সব? কী লাভ হল পাহাড়ের মানুষের? বুদ্ধবাবু পাহাড়ের রাজনীতি তেমন ধরতেই পারলেন না। সেই সুযোগে রঙ্গমঞ্চে গুরুঙ্গ চলে এলেন। কিন্তু পাহাড়ের মানুষ তাঁকে যত না ভক্তি করেছে, তার থেকে বেশি ভয় পেয়েছে। ভয় পেয়ে সভায় গিয়েছে। দিনের পর দিন বন্ধে স্কুল-কলেজ-অফিস-ব্যবসা ডকে তুলে ঘরবন্দি থেকেছে। তাতে লাভ হয়েছে মুণ্ডু!’
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে দার্জিলিঙের। মরিয়া হয়ে পরিবর্তনের পথে হাঁটতে চাইছে সে। ভিড় বাড়ছে তৃণমূলের সভায়। তার পিছনে যত না তৃণমূলের প্রতি আকর্ষণ, তার থেকে বেশি মোর্চার প্রতি বিতৃষ্ণা। পাহাড় বলছে, “মমতার চালে মোর্চা নেতারা চুহা হয়ে গিয়েছেন।” এঁদের কথায় কেন বন্ধ? বেশি ট্যাঁ-ফোঁ করলে মোর্চাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পাহাড়ের স্পষ্ট বক্তব্য: এত দলের এত জনকে এত বছর ধরে অনেক সুযোগ দেওয়া হল, এক বার না হয় দেখা যাক তৃণমূলকে সুযোগ দিয়ে। দেখলাম, মুখ্যমন্ত্রী আসার দু’দিন আগে থেকেই তাঁকে উপহার দেওয়ার শাল বেছে রাখছেন দোকানি। দল বেঁধে কখন তৃণমূলের সভায় যাবেন, সেই পরিকল্পনা চলছে।
আর যদি এ বারও উন্নয়ন না হয়? শান্তি না আসে? যদি তৃণমূলেরও প্রতিশ্রুতি সার হয়? ‘তা হলে হয়তো দিশেহারা মানুষ আবার কারও মগজ ধোলাইয়ের শিকার হবেন, হয়তো আবার পাহাড়ে আগুন জ্বলবে, নতুন রাজ্যের দাবি আবার মাথা চাড়া দেবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, মানুষ এই সব চায় না। একটু ভাল ভাবে থাকতে চায়। সেই স্বস্তিটুকু, সুবিধাটুকু কেউ তাঁদের দিচ্ছে না।’ কোনও নেতা কি কখনও খোঁজ নিয়েছেন ১০০ লিটার জল ৩০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়? “তা-ও হাতে টাকা নিয়ে বসে থাকি, ফোন করে করেও জলের গাড়ির খোঁজ মেলে না।” হোটেলে ১ লিটার জল ১ টাকায় ব্ল্যাক হয়ে যায়। বাড়ি-বাড়ি হয়তো জল আসে ১৫ দিনে এক বার। সারা সপ্তাহের জামাকাপড় জমিয়ে রেখে ছুটির দিন রাস্তার কল বা ঝর্নার জলে লাইন দিয়ে ধুতে গিয়ে দিনের অর্ধেক চলে যায়। বহু জায়গায় ঝর্নার জলও শুকিয়ে আসছে। ওষুধ, ফল, সব আগুনদর। ‘শিলিগুড়িতে যে আপেল ৬০ টাকা দার্জিলিঙে তা ১০০! কেন?’ ও দিকে, ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীদের দাপট বাড়ছে। বাড়ছে পারস্পরিক জাতিগত ক্রোধ। অগ্নিগর্ভ ক্রোধ।
দার্জিলিঙের চার দিকে অবৈধ নির্মাণের রমরমা, যখন-তখন ধস নামছে, রাস্তায়-গলিতে স্তূপীকৃত ময়লা, ম্যালে ঘোড়ার মল-ময়লা ছড়ানো, রাস্তা বাতিহীন, জনপরিবহণের অবস্থা দুর্বিষহ। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য নামী স্কুলগুলিতেও বাইরে থেকে ছাত্রছাত্রীদের পাঠাতে চান না বাবা-মায়েরা। চাকরিবাকরি নেই, অসংখ্য শিক্ষিত বেকার। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয় না বললেই চলে। এমন ‘ব্রেন ড্রেন’ হচ্ছে যে ভয় হয়, এক সময় নতুন প্রজন্মের কেউ হয়তো আর থাকবেই না। অর্থনীতির শিরদাঁড়া পর্যটন, অথচ তা নিয়ে প্রশাসনের হেলদোল নেই। কথায়-কথায় অচলাবস্থা, বটানিক্যাল গার্ডেন নরককুণ্ড, ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ টয় ট্রেনে আলো খারাপ, টয়লেটে জল নেই, ফার্স্ট ক্লাস কামরা জুড়ে প্রস্রাবের দুর্বিষহ গন্ধ। রোপওয়ে কথায় কথায় খারাপ, চিড়িয়াখানায় দেখভাল নেই।
দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অধিকাংশ সূচক দার্জিলিং জেলায় তলানিতে ঠেকেছে। স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান (২০১১-১২) অনুযায়ী, পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচিই হোক বা রুটিন টিকাকরণ দার্জিলিং শেষ সারিতে। জননী সুরক্ষা যোজনার আওতায় পুরুলিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া জেলায় ২০১১-১২ সালে ২৫ হাজার মা সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশুর জন্ম দিয়েছেন, দার্জিলিঙে সংখ্যাটা সবচেয়ে কম। মাত্র ৭৮৫৩! পালস পোলিয়ো কর্মসূচি, রিপ্রোডাকটিভ-চাইল্ড হেলথ শিবির আয়োজন করা যায়নি বললেই চলে। যক্ষ্মা বা এইচআইভি’র সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে স্কুলে পড়া ১৫ বছরের মেয়েদের ৭০ শতাংশ এবং ১৭ বছরের ছেলেদের ৬৩ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে।
মানবসম্পদের এই ক্ষয় এখনই না আটকালে পাহাড়ের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে যে সময় লাগবে না, সেটা মোর্চা নেতাদের বোঝা উচিত। একই সঙ্গে তৃণমূলও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে, পাহাড়ে উন্নয়নে সাফল্য মানে মমতার প্রশাসক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়া এবং আগামী লোকসভা ভোটে এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া। তাই অনেক দিন পর ‘অ্যাডভান্টেজ’ পাহাড়ের মানুষের। ‘আন্দোলন-টান্দোলন’ এক পাশে সরানো থাক। দিন বদল কি অবশেষে হচ্ছে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.