প্রবন্ধ ১...
‘নিশ্বাস নেওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’
বায়ু দূষণ থেকে ক্যানসার হওয়া সম্ভব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই ঘোষণা নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক শোরগোল হয়েছে। কথাটা অজানা ছিল না, তবে তাতে ‘সরকারি’ সিলমোহর পড়ল, এটা কম কথা নয়। আর ঠিক এইখানেই সামনে উঠে আসছে বায়ুদূষণের বিষয়টি। চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়ে রাজ্য সামনের সারিতে থাকলেও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে ডাহা ফেল, তা বামপন্থীরাও মানবেন। স্পঞ্জ আয়রনের মতো দূষিত শিল্পকে আগলে রাখা থেকে শুরু করে গাড়ির ধোঁয়ার দূষণ, সব ক্ষেত্রেই কমবেশি অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেছে বাম সরকার। বিশেষ করে দূষিত গাড়িদের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রাক্তন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী মহাশয়ের ভূমিকা তো ‘ঐতিহাসিক’।
কিন্তু পরিবর্তনের পরে? না, নতুন আমলেও অবস্থা বিশেষ পালটায়নি। বরং শহরের রাস্তা থেকে সাইকেল সরিয়ে আর ‘কাটিং’ তেলে চলা ভ্যানকে অনুমতি দিয়ে উল্টো সংকেত যাচ্ছে। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন করে বুঝিয়ে দিল, ক্রান্তিকাল উপস্থিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ধার করে বলা যায়, এ বার নয়তো নেভার। বায়ুদূষণ কমাতে এখনই মাঠে না নামলে কলকাতা, লন্ডন নয়, মহেঞ্জোদরো হতে পারে।

এক কথায়, ভয়ঙ্কর। রাজ্য, কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে এ সত্য বারে বারে উঠে এসেছে। কলকাতায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাসমান শ্বাসযোগ্য ধূলিকণা। সর্বোচ্চ অনুমোদিত সীমার চেয়ে এ শহরে বছরে গড়ে সেটা দেড় থেকে দুই গুণ থাকে, আর শীতকালে তার মাত্রা দাঁড়ায় সীমার চার বা পাঁচ গুণ। আরও ভয়ের কথা, কলকাতার বাতাসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাসমান কণা বেশি, যা ফুসফুসের একেবারে ভিতর পর্যন্ত যায় ও বিভিন্ন শ্বাসজনিত রোগ থেকে ক্যানসার পর্যন্ত ঘটাতে পারে। পাশাপাশি, শহরের বাতাসে রয়েছে অধিক মাত্রায় নাইট্রোজেন অক্সাইড, বেঞ্জিন বা ‘পলই্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন’ যারা সরাসরি ক্যানসার বা অন্যান্য ফুসফুস ও শ্বাস-সংক্রান্ত রোগ, যেমন অ্যাজমা ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নিঃশব্দে শহরবাসীর দেহে প্রতিস্থাপন করে চলেছে। সে দিন বোধহয় দেরি নেই, যখন বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ জারি করতে হবে ‘এই শহরে নিশ্বাস নেওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর’!
কথার কথা নয়, ২০০০ সালের গোড়ায় ভয়ঙ্কর দূষণের তথ্য পাওয়ার পর তত্‌কালীন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কলকাতা বইমেলাকে এমন ঘোষণা করতে নির্দেশ দিয়েছিল যে, ‘এই মেলার পরিবেশ বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য উপযুক্ত নয়’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষা করে দেখেছে যে, ১১০০ শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে কলকাতার স্থান পঁচিশতম, আর বড় শহর ধরলে আমাদের দেশের দিল্লি ও পাকিস্তানের কয়েকটির পরেই। এবং এর পরিণামও চোখের সামনে! দেশের মধ্যে সর্বাধিক ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় এ শহর থেকে, এমনকী মহিলাদের মধ্যেও, যাঁরা (অন্তত এ দেশে) সিগারেট বা তামাক তুলনায় কম ব্যবহার করেন, তাই ধরে নেওয়া যায়, তাঁরা বায়ুদূষণের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। শ্বাসজনিত রোগের ক্ষেত্রেও তথৈবচ। শহরে গড়ে সাত জনে দু’জন শ্বাসের রোগে আক্রান্ত। ফুসফসের ব্যাধি বিশেষজ্ঞদের কথায়: ‘গত এক দশকে রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।’ রক্ষা পাচ্ছে না স্কুলপড়ুয়া বা মায়ের কোলের শিশুরাও।
শুধু কলকাতা নয়, বায়ুদূষণের ফলে কমবেশি আক্রান্ত গোটা রাজ্য। কলকাতার ক্ষেত্রে মূল কারণ যদি হয় আইন না মেনে সর্বদা কালো ধোঁয়া ছাড়া বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি ও অন্যান্য যানবাহন; তবে শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলে সমস্যা কোথাও গাড়ির সঙ্গে ইচ্ছামত ধোঁয়া ছাড়া, স্পঞ্জ আয়রন, কখনও ইটভাটা বা চালকল। লক্ষণীয়, রাজ্যে গত কয়েক দশকে শিল্পের পরিমাণ তেমন না বাড়লেও শিল্প থেকে হওয়া দূষণ কমেনি। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কলকাতা ও তার চার পাশের অসম্ভব বেশি জনঘনত্ব। সাম্প্রতিক হিসেব জানাচ্ছে যে, পৃথিবীর মধ্যে, হ্যাঁ দেশের নয়, পৃথিবীর, ম্যানিলার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনঘনত্বের শহরাঞ্চল হল টিটাগড়, তৃতীয় বরাহনগর, চতুর্থ শ্রীরামপুর। প্রথম আঠারোটিতে কলকাতা-সহ শহরতলির ছ’টি শহর। পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনত্বের অঞ্চলে যদি সর্বোচ্চ সীমায় প্রাণঘাতী দূষণ হয়, তার ফল যে ভয়ানক হতে চলেছে, তা বলতে বিজ্ঞানী হতে হয় না।

চিরকালই এ রাজ্যে পরিবেশের বিরুদ্ধে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলির মহাজোট চলেছে। কখন সম্মুখসমর, কখনও আড়াল রেখে। ২০০৮ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে বৃহত্তর কলকাতায় টু-স্ট্রোক কালো অটো বা পনেরো বছরের চেয়ে পুরনো গাড়ি যখন বাতিল হয়ে গেল, দেখা গেল, ডান বাম সবাই ‘জীবিকা’ যাওয়ার যুক্তি সাজিয়ে দূষণ সৃষ্টিকারী অটো বা অন্যান্য গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পরে আদালতের চাপে মূল শহর থেকে কিছু অটো বাতিল হলেও, বা পনেরো বছরের পুরনো বাণিজ্যিক গাড়ি সরে গেলেও, বৃহত্তর কলকাতায় তারা রমরমিয়ে চলছে, কেউ সরাসরি বুক বাজিয়ে, কেউ বা গায়ের রংটা পাল্টে ফেলে। কেন দূষণের বিরুদ্ধে রাজনীতির এই অবস্থান? নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু অর্থনীতিবিদ প্রবাল রায়ের সঙ্গে একটা সমীক্ষা করতে গিয়ে বুঝেছিলাম, কিছুটা অর্থনীতির কারণে, বেশিটা রাজনৈতিক লাভের লক্ষ্যে। অর্থনীতির ভাষায় একে বলে ‘পলিটিকাল রেন্ট সিকিং’। অর্থাত্‌, রাজনীতিকে ভাড়া (আসলে উত্‌কোচ) দিয়ে বেআইনি কাজ করার ছাড়পত্র পাওয়া। তাতে দূষকেরও সুবিধা, রাজনীতিকদেরও সুবিধা। আর প্রশাসন নামক প্রাণীটির চোখে ঠুলি পরানোর জন্য তো রাজনীতিকরাই আছেন। অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি এমন বেআইনি বন্দোবস্তে কাজের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ভাবে চলা লক্ষ লক্ষ গাড়ির ও অন্যান্য কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত কয়েক কোটি মানুষের রাজনৈতিক আনুগত্য সুনিশ্চিত হয়, বিশেষ করে রেষারেষি-সর্বস্ব ভোটের বাজারে। তাই, আদালতের চাপে প্রশাসন দূষিত অটো পাল্টানোর উদ্যোগ নিলে রাতারাতি লাল পতাকা নামিয়ে ঘাসফুল লাগিয়ে নেয় শহর ও শহরতলির লাখের কাছাকাছি অটোচালক। রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে যায় দূষণকে অপরিবর্তনীয় রাখতে। মনে রাখতে হবে, কেউ কিন্তু লাল পতাকা ফেলে দেননি, এই জমানায় আবার কখন সমস্যায় পড়তে হবে কে বলতে পারে?
প্রশ্ন হল, এই রাজনৈতিক জাঁতাকল থেকে বেরোনোর কি কোনও উপায় নেই? না কি প্রয়োজন নেই? উত্তরটা জানার জন্য দিল্লির দিকে চোখ রাখতে হবে। দিল্লিতে যখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পুরনো গাড়ি বাতিল হয়ে গেল, বা সি এন জি-তে চলা আবশ্যিক হল, তখন কলকাতার মতোই হরেক রাজনীতিক একই সুরে দূষণের পথে দাঁড়িয়েছিলেন, এমনকী সর্বোচ্চ আদালত ঘেরাও করারও হুমকি দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত পরিবেশের পক্ষে থাকায় বৃহত্তর রাজনৈতিক সুবিধা বুঝতে পারেন ও অবস্থান বদল করে পরিবেশের পক্ষে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেন। যদিও দিল্লি এখনও দেশের দূষণ-রাজধানী, তবু, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর ওই সিদ্ধান্তগুলি ছাড়া যে পরিস্থিতি আরও বহু গুণ খারাপ হত, তাতে সন্দেহ নেই। এবং অনেকেই মনে করেন, ঠিকই মনে করেন, শীলা দীক্ষিতের এত দিনের একটানা রাজ্যপাটের পিছনে ‘পরিবেশবন্ধু’ তকমা কাজে লেগেছে। এটা স্পষ্ট যে, দূষণকে সমর্থন করলে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থ সামলাতে সুবিধা হতে পারে, কিন্তু পরিবেশকে সমর্থন করলে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত হতে পারে।

বায়ু দূষণ সামলাতে ও শহর তথা রাজ্যের মানুষকে ক্যানসার ও অন্যান্য হাজার রোগের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ থেকে মুক্তি দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন সময় ও সুযোগ আর পাবেন না। এখনও তাঁর রাজত্বে কমবেশি মধুচন্দ্রিমার রেশ চলছে, সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ও পুরসভা ফলে তারই পরিচায়। বিরোধী পক্ষ এখনও কোন পথে যাবে, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। নাগরিক সমাজ নিশ্চিত ভাবেই দূষণ কমানোর পক্ষে। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশ রয়েছে এবং প্রয়োজন হলে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আইনি নির্দেশ বের করা যাবে। প্রয়োজন প্রথমত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এখন যেন পরিবেশ সংক্রান্ত যে কোনও অভিযোগকেই ‘অগ্রাহ্য’ করাই পরিবেশের অভিভাবকদের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যতক্ষণ বাজির শব্দ দূষণ কমাতে না বলেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ হাত গুটিয়ে বসে থাকে, জলা-ভরাট আটকাতে পরিবেশ দফতর মাঠে নামে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশ পাওয়ার পরেই। পুরনো জলা বাঁচানোর সরকারি প্রস্তাব, যা কিনা পরিবেশ দফতরের নির্দেশেই তৈরি কমিটি করেছিল, এক বছর ফাইলবন্দি হয়ে আলমারিতে পড়ে থাকে। স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণ আটকাতে তৈরি কমিটি দূষণ আটকানো ছাড়া ‘অন্যান্য’ সব কাজে ব্যস্ত থাকে।
ভয় এখানে, আশাও এখানে। আর পাঁচটা ব্যাপারের মতোই, পরিবেশের ক্ষেত্রেও এটা স্পষ্ট যে, মুখ্যমন্ত্রী বললে তবেই কাজ হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী শুধু ‘বলে দিলেই’ কাজ হবে না। এক সরকারি আধিকারিক এই প্রসঙ্গে বললেন, ‘ছ’মাসে নবান্নে যাওয়া আর দূষণ কমাতে পদক্ষেপ করার মধ্যে তফাত আছে।’ কেন? ‘প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রী দূষণ কমানোর চেষ্টা করলে যে অদৃশ্য ও দৃশ্য স্বার্থগুলিতে টান পড়বে, যাদের অনেকের সঙ্গেই আবার দল ও দলীয় নেতা-কর্মীরা যুক্ত, সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে, তার পর ঠিক মানুষদের সামনে রেখে একটি সময় ধরে পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করতে হবে’। তিনি একশো দিন, পাঁচশো দিন ধরে কাজ করতে ভালবাসেন। এই কাজটিও তেমনই দাবি করে।
সারা রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের, তা তিনি তৃণমূলের সমর্থকই হোন বা বামপন্থী, একটিই চাওয়া: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দূষণের বিরুদ্ধে এই লড়াইটা লড়ে দেখান। কেননা, এই লড়াই না লড়লে এই শহর মত্যুপুরীতে পরিণত হবে। শীতকালে প্রাকৃতিক কারণেই দূষণ-চাদর পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে। নবান্ন-র চোদ্দো তলায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধান দুটি দূষিত শহর কলকাতা ও হাওড়ার দূষণের আদিগন্ত চাদর দেখতে দেখতে মুখ্যমন্ত্রী একটু ভাববেন কি?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.