|
|
|
|
অনভিজ্ঞ ইমতিয়াজদের জন্যই ভেস্তে গেল ছক |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি
স্বপন সরকার • পটনা |
বিস্ফোরকের ‘টাইমারে’ ব্যাটারি বদলাতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা গেল এক জন। ধরা পড়ে গেল দ্বিতীয় জনও। না হলে আরও একটা শ্রীপেরুমপুদুর হতেই পারত রবিবারের পটনা। নরেন্দ্র মোদীর সভার দিনে পটনায় ধারাবাহিক বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে একের পর এক তথ্য সংগ্রহের পরে এমনটাই দাবি করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, ১৯৯১ সালের ২১ মে শ্রীপেরুমপুদুরে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর জনসভায় এলটিটিই যা করেছিল, রবিবার পটনায় নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় সে রকমটাই করতে চেয়েছিল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। কিন্তু বিস্ফোরণের দায়িত্ব পাওয়া দলটির অনভিজ্ঞতার জন্যই শেষ পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা ভন্ডুল যায়। বড় ধরনের নাশকতার হাত থেকে বেঁচে যান বিজেপির শীর্ষ নেতারা।
গোয়েন্দাদের দাবি, আইএম-এর যে দলটি রবিবার পটনায় ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে দু’জনকে আলাদা ভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ‘মানববোমা’ হওয়ার। এরা হল ধৃত ইমতিয়াজ আনসারি এবং পটনা স্টেশনের বিস্ফোরণে মৃত এনুল। গোয়েন্দাদের দাবি, ইমতিয়াজ ও এনুলের উপরে নির্দেশ ছিল, সমস্ত বোমা যথাস্থানে রাখার পর্ব শেষ করে নিজেদের শরীরে বিস্ফোরক বেঁধে ‘মানববোমা’ হতে হবে। ওই দু’জন এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহীও ছিল। মোদী ছিলেন ইমতিয়াজের লক্ষ্য। সে কারণে মোদীর মঞ্চে কোনও ভাবে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল ইমতিয়াজের। আর এনুলের থাকার কথা ছিল নীচে, মঞ্চের সামনে। কিন্তু পটনা স্টেশনে বিস্ফোরণে এনুল মারা যায় এবং ওই বিস্ফোরণের পরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় ইমতিয়াজ। ভেস্তে যায় জঙ্গিদের মানববোমা বিস্ফোরণের ছকও। |
|
গাঁধী ময়দানে বিস্ফোরণের জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে টাইমারটি।
সোমবার রাঁচিতে, এক পুলিশ অফিসারের হাতে। ছবি: পিটিআই। |
গোয়েন্দাদের দাবি, পটনায় ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ছক কষা হয়েছিল রাঁচিতে। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের নতুন ‘অপারেশনাল চিফ’ তেহসিন আখতার ওরফে মনুর গড়ে তোলা মডিউলের তিনটি আলাদা দল এই বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত। শুধু দলের ছেলেদের কাজে লাগানো নয়, তেহসিন নিজে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভাবে মাঠে নেমেছিল বলেও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তদন্তকারীদের দাবি, তেহসিন এবং ওয়াকাস বিস্ফোরক জোগাড় করেছিল। দলের বাকি সদস্যরা সেই বিস্ফোরক পৌঁছে দেয় নানা জায়গায়।
তদন্তে নেমে পটনা বিস্ফোরণের সঙ্গে বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণের মিল পেয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। দু’জায়গাতেই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং জিলেটিন স্টিক পাওয়া গিয়েছে। তার পরেই গোয়েন্দারা এক রকম নিশ্চিত হয়ে যান যে, এই কাজ ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের। পটনায় বিস্ফোরণে ব্যবহৃত বোমাগুলি যে রাঁচিতেই বানানো হয়েছিল, সেই ব্যাপারেও মোটামুটি নিশ্চিত গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, পটনা বিস্ফোরণের আগে রাঁচিতে ছিল তেহসিন। তার আগে সে রাজস্থানের পুষ্করেও গিয়েছিল। রাঁচির মডিউলটি সম্প্রতি তৈরি করে তেহসিন। এই দলের অনেকেই বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণেও জড়িত ছিল। যে সাতটি আইইডি বিস্ফোরণ হয়েছে, সেগুলি ছাড়াও আরও আটটি আইইডি উদ্ধার হয়েছে। বুদ্ধগয়া ও পটনা, দু’ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিস্ফোরকের মধ্যেও অনেক মিল পাওয়া গিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে বিস্ফোরণের জন্য দুই জায়গাতেই একই ধরনের ঘড়ি বা টাইমার ব্যবহার করা হয়েছে। আজ দিল্লি পুলিশ ইয়াসিন ভটকলকে হেফাজতে নিয়েছে। তাকে জেরা করে আরও তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলবে।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার দাবি করেছেন, মোদীর জনসভায় বিস্ফোরণ নিয়ে কোনও গোয়েন্দা-তথ্য ছিল না। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের দাবি, ২৩ অক্টোবরই বিহার পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছিল। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের পাণ্ডা ইয়াসিন ভটকলের গ্রেফতার, তাকে জেরা করে এবং বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ওই নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য পাঠানো হয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওই সতর্কবার্তা (ক্রমিক সংখ্যা ৩১১/২০০/২০১৩-৩)-য় বলা হয়, মোদীর পটনার জনসভায় নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। অভিযোগ, তার পরেও সভার দু’দিন আগে পুলিশ কেবল মাত্র মঞ্চ ছাড়া ময়দানের আর কোনও জায়গায় তেমন ভাবে তল্লাশি করেনি। অথচ জঙ্গিরা কয়েক দিন আগেই এই সব এলাকায় ‘রেকি’ করে গিয়েছে বলে পরে তদন্তে জেনেছেন গোয়েন্দারা। কেন্দ্রীয় সতর্কতার পরেও মোদীর সভায় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র ছ’হাজার পুলিশ গাঁধী ময়দান ও তার আশপাশ এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছিল। অথচ কয়েক মাস আগে, গত ১৭ মার্চ ওই গাঁধী ময়দানেই মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ‘অধিকার র্যালি’তে মোতায়েন করা হয়েছিল ১৭ হাজার পুলিশ! নীতীশের ওই সভায় নজরদারি করার জন্য গাঁধী ময়দান ও সংলগ্ন এলাকাগুলিতে বসানো হয়েছিল অসংখ্য সিসিটিভি। কিন্তু মোদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার ক্ষেত্রে কেন বিহার পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসন সে রকম নিরাপত্তার আয়োজন করেনি, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
কেন্দ্রের পাঠানো ওই সতর্কবার্তা প্রসঙ্গে রাজ্য পুলিশের এডিজি (সদর) রবীন্দ্র কুমারের ব্যাখ্যা, “এটি একটি সাধারণ সতর্ক বার্তা ছিল। তাতে নির্দিষ্ট করে কোনও কিছু বলা ছিল না।” পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এক বড় কর্তার কথায়, “নরেন্দ্র মোদীর র্যালির আগে এই সতর্কবার্তা পাঠানোর অর্থ কী, তা অভিজ্ঞ পুলিশ কর্তাদের বোঝা উচিত ছিল। পেশাদার পুলিশ কর্তারা যদি সেটা না বুঝতে পারেন তবে সেটা অপরাধ।” এডিজি রবীন্দ্র কুমার বলছেন, “সাধারণ সতর্ক বার্তায় বলা হয়নি, রাঁচি থেকে জঙ্গিরা এসে এই ঘটনা ঘটবে।” ওই প্রাক্তন পুলিশকর্তার মন্তব্য, “এই যুক্তি হাস্যকর।” বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, দিল্লিতে মোদী বা রাহুল গাঁধীর সাম্প্রতিক জনসভায় যে ভাবে প্রত্যেকের শরীর তল্লাশি করা হয়েছিল, পটনায় তা হয়নি। কেন্দ্রের তরফে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় এই গাফিলতির প্রসঙ্গ উঠবে বলে জানা গিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের দাবি, ওই জনসভায় মেটাল ডিটেক্টর, অ্যাম্বুল্যান্স, কুইক রিঅ্যাকশন টিম-এর মতো প্রাথমিক ব্যবস্থাগুলিও ছিল না।
ইয়াসিন ভটকলের গ্রেফতারের পর থেকেই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন যে পাল্টা প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করবে এবং নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করবে, সেই আশঙ্কা গোয়েন্দাদের ছিলই। বিহারে এমনিতেই মুজাহিদিনের জাল ছড়ানো রয়েছে। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের কুখ্যাত ‘দ্বারভাঙ্গা মডিউল’-এর জন্ম বিহারেই। সেই হিসেবে বিহার পুলিশের এমনিতেই আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের মত। ইতিমধ্যেই সমস্তিপুরের বাসিন্দা তথা আইএম-এর নতুন ‘অপারেশনাল চিফ’ তেহসিন আখতার ওরফে মনুর খোঁজে পুলিশ তল্লাশি শুরু করেছে। নেপাল সীমান্ত ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। গতকালের ঘটনার পর বিজেপি দাবি তুলেছে, মোদীর নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হোক। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দের যুক্তি, “কেন্দ্রীয় সরকার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছে।” মোদী এখন জেড-প্লাস নিরাপত্তা পান। এনএসজি-র কম্যান্ডোরা সর্বক্ষণ তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন। শিন্দে বলেন, “আগামিকাল পটনায় গিয়ে আমি গোটা পরিস্থিতির পর্যালোচনা করব।” যদিও রাতের দিকে একটি সূত্রের খবর, সম্ভবত মঙ্গলবার পটনায় যাবেন না শিন্দে। গতকালের বিস্ফোরণের পর শিন্দের দিকেও আঙুল উঠেছে। বিস্ফোরণের পরে মুম্বইয়ের একটি হিন্দি ছবির গানের অ্যালবাম প্রকাশ অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন তিনি। প্রশ্ন উঠেছে, ২৬/১১-র পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিলকে গদি ছাড়তে হয়। তা হলে শিন্দে কেন গদি ছাড়বেন না? শিন্দের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন বিজেপি নেতা কীর্তি আজাদ। কংগ্রেস নেতৃত্বের অবশ্য যুক্তি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন কি না, সেটাই আসল প্রশ্ন। পটনার ঘটনার দু’ঘণ্টার মধ্যে এনএসজি ও এনআইএ-র দল বিশেষ বিমানে করে পটনা পৌঁছে গিয়েছে। যা নজিরবিহীন।
|
ষড়যন্ত্রের জাল |
• বিস্ফোরণের ছক কষা হয় রাঁচিতে
• তিন দলে ভাগ হয় তেহসিনের তৈরি মডিউল
• আগে জায়গাটা দেখে যায় তারা
• অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ও জিলেটিন স্টিক দিয়ে বিস্ফোরণ
• মঞ্চের নীচে মানববোমা হওয়ার কথা ছিল এনুলের
|
ফাঁকফোকর |
• নীতীশের সভায় পুলিশ ১৭ হাজার, মোদীর সভায় ৬ হাজার
• নীতীশের সভার মতো সিসিটিভি বসেনি
• সভামঞ্চ ছাড়া তল্লাশি হয়নি ময়দানের অন্যত্র
• শরীর তল্লাশি হয়নি, অভিযোগ বিজেপি-র
• বম্ব স্কোয়াড গা লাগায়নি, বলছে স্বরাষ্ট্র দফতর |
|
পুরনো খবর: মুজাহিদিনকে সন্দেহ, সময়ই প্রশ্ন নীতীশের |
|
|
|
|
|