সত্যরে লও সহজে, বার্তা দিয়েছিল ভিকি অরোরার জীবন। টাকার বিনিময়ে ভিকি শুক্রাণু দান করত স্পার্ম ব্যাঙ্কে। তার সেই দানে সন্তানহীন দম্পতিদের কোল আলো করে আসত সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তান। কিন্তু সেই শিশুদের জিনগত পিতৃ-পরিচয় সবাইকে জানিয়ে দেওয়াই কি মঙ্গল শিশু ও গোটা সমাজের পক্ষে? এই প্রশ্নটাকে ঘিরেই বিতর্কে তেতে উঠল রবিবারের কলকাতা। কিন্তু দেখা গেল এ নিয়ে একমত হতে পারছেন না কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক ও মনোবিদরা।
‘ভিকি ডোনার’ ছবি দেখিয়েছে, সন্তানলাভের আশায় দিল্লির দরিয়াগঞ্জ এলাকার ওই ফার্টিলিটি ক্লিনিক কিংবা শুক্রাণু ব্যাঙ্কে ভিড় জমাচ্ছে সন্তান না পাওয়া বহু দম্পতি। তবে শুক্রাণুদাতার পরিচয় শুধুমাত্র চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ জানতে পারছে না। এক শুক্রাণুদাতার জীবন নিয়ে তৈরি ওই ছবি সাড়া ফেলে দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল বিতর্ক। জুটেছিল পুরস্কারও। শুক্রাণুদাতাদের পরিচয় সন্তানের জানা উচিত কি না সেলুলয়েডের সেই প্রশ্নটাকে মাঝে রেখেই এ দিন তর্কে বসেছিলেন চিকিৎসক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, গৌতম খাস্তগীর, সুতপা গঙ্গোপাধ্যায়, নীলাঞ্জনা সান্যাল, দেবেশ রায়, রীতা ভিমানি-সহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। কারণ, প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা ক্রমেই বাড়ছে এই শহরেও। স্বামী বা পুরুষসঙ্গীর কোনও সমস্যা থাকলে এখন সন্তান লাভের আশায় অনেক দম্পতিই শুক্রাণুদাতার সাহায্য নিচ্ছেন। একা কোনও মহিলা যদি সন্তান চান, তাঁকেও শুক্রাণুদাতার সাহায্য নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মানুষদের মানসিকতার বদল হলেও, তাঁদের পরিবার কিংবা সমাজ কি সেই বদলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে?
কেউ বললেন, সন্তানের বয়স ৫ বছরের বেশি হলেই তাকে তাঁর ‘বায়োলজিক্যাল’ পিতার পরিচয় জানানো উচিত। কেউ বলছেন, সত্য জানানোর জন্য সন্তান সাবালক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়। আবার কারও মতে, ভারতীয় সমাজে এমন সত্য সামনে না আসাই মঙ্গল, জানাজানি হলে পারিবারিক স্থিতি নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। সন্তান সাবালক হলেই তাকে সত্য জানানো উচিত। শুধু সন্তান নয়, দাতার স্ত্রীর পক্ষেও এই সত্যের চাপ গুরুপাক হয়ে উঠতে পারে। ‘ভিকি ডোনার’ ছবিতে ভিকির স্ত্রী অসীমা স্বামীর শুক্রাণু দানের কথা জানতে পেরে নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি। অপমানে-অভিমানে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। চিত্রনাট্য অবশ্য শেষ পর্যন্ত মিলিয়েই দিয়েছিল সংবেদনশীল দু’টি মনকে। বাস্তবে কি তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকশন এবং বেঙ্গল অবস্টেট্রিকস অ্যান্ড গাইনিকোলজিকাল সোসাইটি আয়োজিত এই আলোচনাসভায় চিকিৎসক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী জানান, তিনি নিজে টেস্ট টিউবের সাহায্যে বহু সন্তানহীন দম্পতিকে সন্তান জন্ম দিতে সাহায্য করেছেন। এমনকী বর্তমানে শুক্রাণু, ডিম্বাণু নিষিক্ত করে এবং গর্ভদাত্রীর মাধ্যমে বন্ধ্যাকেও দিচ্ছেন মাতৃত্বের স্বাদ দিচ্ছেন। তিনি-ও কিন্তু সন্তানকে জিনগত বাবার পরিচয় জানানোর বিপক্ষে। তাঁর কথায়, “বিদেশের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার ফারাক রয়েছে। এখানে জিনগত বাবার পরিচয় দিলে পরবর্তীকালে সেই সন্তান বড় হয়ে সেই ব্যক্তির কাছে পৌঁছে সন্তানের দাবি-দাওয়া করলে সেই শুক্রাণু দাতা সমস্যায় পড়বেন। কারণ তত দিনে তিনি হয়তো নিজের একটি পারিবার গড়ে তুলেছেন।”
শিশু চিকিৎসক সুতপা গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু মনে করেন, সন্তানের বয়স ৬-৭ বছর হলেই তাকে গল্পের ছলে আস্তে আস্তে তার জন্ম-বৃত্তান্ত জানানো উচিত। বড় হয়ে জানতে পারলে মানসিক দিক থেকে সত্যকে স্বীকার করা শক্ত হয়ে ওঠে। কারণ তখন তার বয়ঃসন্ধির সময়। তিনি বলেন, “আশৈশব যাকে সে বাবা বলে জেনে এসেছে, সেই ব্যক্তি তার জন্মদাতা বাবা নন, পরে এটা জানতে পারলে মনে শুরু হবে নানা টানাপোড়েন।”
প্রায় একই বক্তব্য মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের। তিনিও বললেন, “সাবালক অবস্থায় সন্তান যদি তার জন্ম-বৃত্তান্ত সম্পর্কে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা কিছু শোনে, তার মনে এই মা-বাবা সম্পর্কে অবিশ্বাস তৈরি হবে। আর তার জেরে বিপথেও যেতে পারে সেই সন্তান। তাই একটু বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই এই ধরনের সন্তানদের খোলাখুলি জন্ম-বৃত্তান্ত জানিয়ে দেওয়া ভাল। আর সমাজ ব্যবস্থা যে ভাবে বদলাচ্ছে, তাতে সেই সন্তানও বুঝতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
স্ত্রী রোগ চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীর বলেন, “এখন অনেক মহিলা সিঙ্গল পেরেন্ট হতে চান। বহু উদার পরিবারে সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সত্যিটা বলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও জড়তা কাজ করে না। শুক্রাণুদাতার পরিচয় না জানালেও কী ভাবে তার জন্ম, সেটা অন্তত তাকে জানিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেন অনেকেই। তবে সবটাই সংশ্লিষ্ট পরিবারের মানসিকতার উপরে নির্ভর করে। আমাদের আশা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা হয়তো আরও বদলাবে।”
তাতেও কি পর্দার সত্যটা বাস্তবের সমাজে মসৃণ ভাবে নিতে পারবে সকলে? এই প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় হ্যাঁ বা না বলে দায় সারেননি কেউ। নিজ-নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নানা সম্ভাবনার দিক তুলে ধরেছেন এ দিনের বক্তারা। চটজলদি সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর বদলে বিতর্কটা তাই জারিই রইল। এবং বিতর্কটা যে চলছে, ছড়াচ্ছে, ক্রমেই আরও বেশি-বেশি মানুষকে ভাবাচ্ছে সেটাই বুঝি এই মুহূর্তে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন, সমাজের আরও কিছুটা পরিণতমনস্ক হয়ে ওঠার পথে। |