দুর্গাপুজো থেকে টানা নিম্নচাপে চাষজমিতে জল দাঁড়িয়ে কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে বাঁকুড়ায়। মাথায় হাত পড়েছে চাষিদের। জলের তলায় এখনও বহু জমি। বাজারে সব্জির দামও তাই আকাশছোঁয়া। জেলার উপ-কৃষি অধিকর্তা অনন্তনারায়ণ হাজরা বলেন, “টানা নিম্নচাপে জেলায় প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৯ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা।” তিনি জানান, প্রায় ৬১০ হেক্টর জমির খরিফ সব্জি এবং প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে রবি সব্জি নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি, প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধান ও ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, জেলার সব ক’টি ব্লকেই কমবেশি চাষে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি দফতরের তথ্য অনুসারে, জেলায় অক্টোবর মাসে গড় যা বৃষ্টি হয়, এ বার চার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়েছে। চলতি মাসের ১২ তারিখ থেকে শনিবার পর্যন্ত ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর এই অতিবৃষ্টিই কাল হয়েছে চাষের। বিষ্ণুপুরের অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের পেঁচাগড়া গ্রামের চাষি বীরেন কুণ্ডু এ বছর ৮ বিঘা জমিতে পটল, বাঁধাকপি, লঙ্কা ও পালং শাক চাষ করেছিলেন। অতিবৃষ্টিতে জমিতে জল দাঁড়িয়ে সব ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জমিতে পচে যাওয়া বাঁধাকপির দিকে তাকিয়ে বীরেনবাবুর আক্ষেপ, “এই আট বিঘা জমিতেই সব্জি চাষ করে গত বছর ৫০ হাজার টাকার বেশি রোজগার করেছিলাম। এ বছর সব শেষ!” |
বীরেনবাবুর জমির পাশেই চাষজমি রয়েছে এই গ্রামের বাসিন্দা কার্তিক কুণ্ডু, সত্যবান কুণ্ডু, রঞ্জিত কুণ্ডুদের। কয়েক হাজার টাকা বিনিয়োগ করে চাষ করেছিলেন। জমিতে জল দাঁড়িয়ে তাঁদেরও ধান, সব্জি নষ্ট হয়েছে। তাঁরা বললেন, “মাঠের ফসল মাঠেই মারা গেল। চাষের উপরই আমরা নির্ভরশীল। হাজার হাজার টাকা লোকসান সামলে উঠব কী করে, বুঝে উঠতে পারছি না।” ওন্দা ব্লকের এক্তারপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃণাল কোটাল দু’বিঘা জমিতে শাঁক আলু লাগিয়েছিলেন। জমিতে জল দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সব ফসলই নষ্ট। তাঁর কথায়, “গত বছর এই চাষ করে আমি কয়েক হাজার টাকা পেয়েছিলাম। এ বার বৃষ্টিই সব শেষ করে দিল।” ওন্দারই নিকুঞ্জপুরে জমিতে জল দাঁড়িয়ে বরবটি, লঙ্কা, উচ্ছে, ঝিঙের মতো সব্জির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিকুঞ্জপুরের চাষি স্বপন কোলে ১০ কাঠায় বরবটি ও ঝিঙে লাগিয়েছিলেন। তাঁর জমিতেও জল থইথই। সব্জি পচে গিয়েছে। ওন্দা ব্লকের ভাটিয়াড়া গ্রামের গোপাল বাউরি পাঁচ কাঠা জামিতে শসা চাষ করেছিলেন। অতিবৃষ্টিতে তার অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। |
বৃষ্টি থামতেই শুরু হয়েছে পোকার আক্রমণও। বাঁকুড়ার মোবারকপুর ও রাইপুরের
খাদুকানালি
গ্রামে কপির খেতে ছবিগুলি তুলেছেন অভিজিত্ সিংহ ও উমাকান্ত ধর। |
বাঁকুড়া ২ ব্লকেও বিঘার পর বিঘা জমির বাঁধাকপি, ফুলকপি ও ধান নষ্ট হয়েছে। মুবারকপুরের বাসিন্দা নীলমণি মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ নন্দীদের ধানের বেশির ভাগই বৃষ্টির জমা জলে এক টানা জমিতে পড়ে থাকায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাঁদের আক্ষেপ, “বেশি বৃষ্টিতে ভেবেছিলাম এ বছর ভাল চাষ হবে। কিন্তু সেই বর্ষার জন্যই ফসল ঘরে আনতে পারলাম না।” জেলার জঙ্গলমহল রাইপুরের চিত্রটাও এক। মটগদা পঞ্চায়েতের খুদেকানালি গ্রামে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণে ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষ হয়। অতিবৃষ্টিতে এ বার ফলন মার খেয়েছে। ওই গ্রামের চাষি নারায়ণ মণ্ডল, মিঠুন লোহার, ধীরেন মণ্ডলদের হতাশা, “এই ফসল বিক্রি করেই আমাদের ঘরে চুলো জ্বলে। চাষে বহু টাকা লাগিয়েছি। কিন্তু, অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংসারে এখন হাতটান চলছে।”
শুধু চাষিদের পরিবারেই নয়, ফসলের এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতির খেসারত গুনতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের। সব্জির টানাটানির জেরে বাঁকুড়ার বাজারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পুজোর আগে যেখানে জ্যোতি আলুর দাম ছিল প্রতি কেজিতে ৮ টাকা, এখন সেখানে কোথাও ১৪, কোথাও ১৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপির দামও কেজি পিছু ৫-৭ টাকা বেড়েছে। রবিবার বাঁকুড়ার চকবাজারেই ৩০ টাকা প্রতি কেজিতে বিক্রি হয়েছে ফুলকপি। একই ভাবে উচ্ছে, ঝিঙে, কুমড়ো, পটল, ঢ্যাঁড়শ, লাউয়ের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আর বেগুনে তো হাতই ছোঁয়ানো যাচ্ছে না!
বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগানের বাসিন্দা জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “সব্জির দর এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। আর ক’দিন পর বোধহয় একবেলা খেয়ে না হয়!” |