|
|
|
|
মঞ্চে নেতারা বলে যাচ্ছেন, বাজি ফাটাবেন না
স্বপন সরকার • পটনা |
মাঠের বাইরে তখন জনসমুদ্র। মাঠের ভিতরেও তাই। গাঁধী ময়দানে নীতীশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার ডাক দিচ্ছেন স্থানীয় বিজেপি নেতারা। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছুঁতে তখনও কুড়ি মিনিট বাকি।
হঠাৎই বিস্ফোরণের আওয়াজে কেঁপে উঠল ময়দান। সপ্তাহ পেরোলেই দিওয়ালি। তায় আবার নীতীশের শহরে নীতীশকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। সেই অত্যুৎসাহে সমর্থকেরা আগাম দিওয়ালি পালন করছেন বলে ধরে নিয়েছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। এমনকী পুলিশও।
কেউই তখনও বুঝতে পারেননি পটনা স্টেশনে বোমা বিস্ফোরণের রেশ এ বার আছড়ে পড়তে চলেছে গাঁধী ময়দানেও। ভুল ভাঙল আগামী এক ঘণ্টার মধ্যেই। ওই সময়ের মধ্যে মোট পাঁচ বার কেঁপে উঠল ময়দান চত্বর। বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা প্রথমে ধরতে পারেননি প্রেস গ্যালারিতে থাকা সাংবাদিকেরাও। ঢোল-নাগাড়া-মাইকের আওয়াজের মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার ছয় মিনিটের ব্যবধানে ঘটে যায় প্রথম দু’টি বিস্ফোরণ। তৃতীয় বিস্ফোরণে সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে যায় ময়দানের একাংশ। মাইকে তখন বিজেপি নেতারা বলে যাচ্ছেন, বাজি ফাটাবেন না। টায়ার জ্বালাবেন না।
কিন্তু আহতদের আর্তনাদ, জনতার হুড়োহুড়ি, অ্যাম্বুল্যান্সের তৎপরতা ততক্ষণে বুঝিয়ে দিয়েছে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের শিকার হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর জনসভা। মুম্বই-দিল্লি-জয়পুর-বেঙ্গালুরু-হায়দরাবাদের পরে সন্ত্রাসের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে পটনাও। |
|
গাঁধী ময়দানে বিজেপির সভা। পটনার আকাশ থেকে তোলা পিটিআইয়ের ছবি।
|
তৃতীয় বিস্ফোরণের পরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। ঘটনাস্থলে তখন আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন অনেকে। আতঙ্ক আর ঘন ধোঁয়ার মধ্যে কোথায় পালাবেন, কোন দিকে যাবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দেহাতি মানুষেরা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় কার্যত সমন্বয়হীন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া পুলিশ, পরিস্থতি দেখে হতভম্ব মঞ্চে থাকা বিজেপি নেতারাও তখন দিশেহারা। মাইকে নেতারা জনতাকে শান্ত হওয়ার আবেদন জানালেও পরবর্তী বিস্ফোরণের আশঙ্কায় সকলেই তখন সকলেই ময়দান ছাড়তে ব্যস্ত। এরই মধ্যে দশ মিনিটের ব্যবধানে ঘটতে থাকে উপর্যুপরি বিস্ফোরণ। ময়দানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এরই মধ্যে খবর আসে পটনা স্টেশন থেকে উদ্ধার হওয়া দ্বিতীয় বোমাটি নিষ্ক্রিয় করতে গিয়েও বিস্ফোরণ ঘটেছে। গুরুতর আহত হয়েছেন বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দফতরের এক কর্মী।
ঘটনার সূত্রপাত এ দিন সকাল সাড়ে ন’টায়। প্রথম বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পটনা জংশন। স্টেশনের ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মের শৌচাগারে হওয়া বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন এক ব্যক্তি। মানুষের ঢল তখন গাঁধী ময়দানমুখী। গোটা স্টেশন চত্বরে যাত্রী ঠাসা। বোমা ফাটার পরে কোথায় যাবেন বুঝতে না পেরে স্টেশনের উড়ালপুলে উঠে পড়েন বহু লোক। কিছুক্ষণের মধ্যে রেল এবং রাজ্য পুলিশের কর্তারা পৌঁছন। চলে আসেন বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দফতরের অফিসারেরা। দেখা যায় শৌচাগারে এক ব্যক্তি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পটনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এই সময়ে এক জনকে পালাতে দেখে পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। ডিজিপি অভয়ানন্দ বলেন, “তার পরিচয় বলা যাবে না। তবে তার থেকে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি।” তবে পুলিশের অন্য সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃত ব্যক্তির নাম ইমতিয়াজ। রাঁচির বাসিন্দা। এ ছাড়াও সন্দেহভাজন চার জনকে পুলিশ আটক করেছে।
গাঁধী ময়দানে যখন ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটছে তারই মধ্যে সভাস্থলের কাছাকাছি এসে পৌঁছন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। ততক্ষণে ময়দানে যাওয়ার দু’টি রাস্তাই জনসমুদ্র। এক দল ছুটছেন নমোকে দেখতে, অন্য দল প্রাণ বাঁচাতে। পটনা সাহিব থেকে আসা অজয় কুমার যেমন বললেন, “নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ শুনতে এসেছিলাম। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব কি না জানি না। এখান থেকে চলে যাচ্ছি।” কোনও মতে ভিড় হঠিয়ে মোদীকে মূল মঞ্চে পৌঁছে সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেন পুলিশকর্মীরা।
কিন্তু বাইরে যাওয়ার রাস্তায় পদপিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। জুতো, জলের বোতল, বোঁচকা-বুঁচকি ফেলে রেখে ছুটতে থাকেন সকলে। বিজেপির পতাকা, টুপি, মোদীর মুখোশ গড়াগড়ি খেতে থাকে মাঠেই। পটনা পুলিশ সুপার মনু মহারাজ দাবি করেছেন, “কম শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে যাতে মানুষ পালাতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়।” মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে বাঁশের ব্যারিকেড খুলে দিয়ে কোনও মতে পরিস্থিতি সামলায় পুলিশ।
এরই মধ্যে সভাস্থলের মূল নিরাপত্তাবেষ্টনীর খুব কাছে আরও একটি বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। সেই বোমাটিই সবথেকে শক্তিশালী ছিল বলে জানা গিয়েছে। আজ সন্ধ্যা ছ’টায় নীতীশ কুমারের সাংবাদিক সম্মেলনের আগে যে বোমাটি নিষ্ক্রিয় করতে ব্যর্থ হয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলে পুলিশ। ওই বোমাটি ফাটলে নিহতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যেত বলেই আশঙ্কা। নেতাদের আহত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না গোয়েন্দারা।
এই ধারাবাহিক বিস্ফোরণ পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন নীতীশ। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে আলোচনা হয় তাঁর। নীতীশকে ফোন করেন লালকৃষ্ণ আডবাণীও। পরে নীতীশ জানান, নিহতদের পরিবারকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আহতদের চিকিৎসা সরকার করবে।
পুলিশি ব্যর্থতার অভিযোগের জবাব দিতে তিনি বলেন, “অভিযোগ আসতেই পারে। তবে পরিকল্পনা করে এটা করা হয়েছে। এটা রাজ্যে কলঙ্ক লাগানোর চেষ্টা।” |
|
|
|
|
|