|
|
|
|
দুর্যোগ-আক্রান্তকে ত্রাণ নয়, মূল্য ধরে দেবে রাজ্য |
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
আর হাতে হাতে ত্রাণ নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্বান্ত মানুষকে এ বার ত্রাণের মূল্য ধরে দেবে রাজ্য সরকার।
মূলত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছাতেই এই পদক্ষেপ বলে জানাচ্ছেন রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের আধিকারিকেরা। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারও সম্প্রতি ‘ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার’ পদ্ধতির মাধ্যমে এই নীতিই প্রণয়ন করেছে, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির হাতে
সরাসরি ত্রাণ-মূল্য পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
রাজ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বন্যা কিংবা অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সব হারিয়েছে এমনই পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এককালীন ৫০০০ টাকা দেওয়া হবে। সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টিতে দুই মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলির যে সব এলাকা প্লাবিত হয়েছে, সেখানকার ক্ষতিগ্রস্তদের হাতেই প্রথম নগদ টাকা তুলে দেবে রাজ্য সরকার। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এক কর্তা বলেন, “ডিভিসি ও ঝাড়খণ্ডের জলাধার থেকে জল ছাড়ার ফলে পুজোর মধ্যেই ওই চার জেলার বহু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ওই সব এলাকা ঘুরে দেখেন। ত্রাণ শিবিরে গিয়ে কথাও বলেন সর্বস্বান্ত মানুষজনের সঙ্গে। তার পরেই ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।” সেই মতো তালিকা তৈরিও শুরু হয়ে গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
এত দিন প্রকৃতির তাণ্ডবে ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে সাধারণ ত্রাণ (জেনারেল রিলিফ) এবং বিশেষ ত্রাণ (স্পেশাল রিলিফ) দিত রাজ্য প্রশাসন। সাধারণ ভাবে ত্রাণ শিবির ছাড়ার পর থেকে এক মাস ধরে ওই ত্রাণ দেওয়া হয়। সব হারানো মানুষগুলো যাতে দু’বেলা খেতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। ওই খাতে পরিবারপিছু খরচ ধরা আছে কমবেশি ৪২০০ টাকা। সরকারি নিয়ম মোতাবেক, প্রাথমিক ভাবে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর ওই খরচ বহন করে। পরে কেন্দ্রের কাছে সেই তথ্য পেশ করলে পুরো টাকাটাই মিটিয়ে দেয় তারা। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের অফিসারেরা হিসেব কষে দেখেছেন, এক মাস ধরে ত্রাণ দেওয়ার বদলে ক্ষতিগ্রস্তের হাতে নগদ ৫০০০ টাকা তুলে দিলে খরচের সিংহভাগ কেন্দ্রের অর্থেই মেটানো যাবে। রাজ্যের ভাগে পড়বে পরিবারপিছু ৮০০ টাকা। বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে ওই চাপ সামলে দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন অর্থ দফতরের কর্তারা।
গত শুক্রবার এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। তাতে বলা হয়েছে, যে সব পরিবার নগদে ক্ষতিপূরণ পাবে, তারা অন্য কোনও সরকারি ত্রাণ বা সাহায্য নিতে পারবে না। তবে ঘরবাড়ি পুরোদস্তুর ভেঙে পড়লে তা সারাই বাবদ ত্রাণ তহবিল থেকে ১৫ হাজার টাকার যে আর্থিক অনুদান পাওয়া যায়, তা আগের মতোই পাবে নিঃস্ব পরিবারগুলি। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খান শনিবার বলেন, “এটা ‘পাইলট প্রজেক্ট’। নতুন প্রক্রিয়ায় কোথায় কী অসুবিধে হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হবে, যাতে পরবর্তী কালে প্রয়োজনমতো সংশোধন করা যায়।”
সরকারি সূত্রের খবর, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে প্রতি রাজ্যকে অনুদান দেয় কেন্দ্র। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ওই বরাদ্দ বাড়ানো হয়। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এক কর্তা বলেন, “এখন ওই খাতে রাজ্যকে ৩৬০ কোটি টাকা দেয় কেন্দ্র। যদি কোনও কারণে ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে ওই টাকা শেষ হয়ে যায়, তা হলে ফের কেন্দ্রের কাছে দরবার করতে হয়।” নবান্ন-র একটি সূত্র বলছে, মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, ক্ষতিগ্রস্তপিছু ১০ হাজার টাকা দিতে। সেই ইচ্ছে পূরণ করতে গেলে বছরে ৮০০ কোটি টাকা দরকার। ওই বিপুল টাকার ব্যবস্থা করতে তারা অপারগ বলে অর্থ দফতর জানিয়ে দেওয়ার পরে ৫০০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয় বলে জানাচ্ছে নবান্ন-র সূত্রটি।
রাজ্য প্রশাসনের একাংশ মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, ত্রাণের ত্রিপল কিংবা কম্বল, এমনকী, চিড়ে-গুড় ও কেরোসিন বিলি নিয়ে দুর্নীতির ভুরিভুরি অভিযোগ ওঠে। অনেক সময় ত্রাণসামগ্রী খোলা বাজারে বিক্রিরও নালিশ জানান ক্ষতিগ্রস্তেরা। ওই অফিসারদের বক্তব্য, ত্রাণ-মূল্য সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছে গেলে কাজে স্বচ্ছতা বাড়বে। একই সঙ্গে ত্রাণ বিলি নিয়ে অভিযোগও কমবে। প্রশাসনের অন্য একটি অংশ অবশ্য এ কথা মানতে চাননি। তাঁরা বলছেন, জল থইথই এলাকায় যেখানে বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে, দোকানপাট বন্ধ, মানুষ অসহায়, তখন ওই টাকা নিয়ে কী করবেন তাঁরা? বহু এলাকায় জল নেমে যাওয়ার পরেও দিন গুজরানের মতো পরিস্থিতি থাকে না। তার চেয়ে দু’মুঠো খাবার দেওয়াই অনেক বেশি কাজের বলে মত ওই অফিসারদের।
বাম আমলে যে কোনও বিপর্যয়ে এলাকায় দেখা মিলত তত্কালীন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের। ত্রাণের বদলে টাকা দেওয়া নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া: ক্ষতিগ্রস্তেরা যদি সত্যিই হাতে টাকা পান, তাতে ভালই হবে। কিন্তু সেই নামের তালিকা নিয়েও যে অভিযোগ উঠবে না, তা কে নিশ্চিত করবে? কান্তিবাবুর কথায়: “চাল-ডাল হাতে পাওয়ার ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তেরা প্রাপ্য বুঝে নিতেন। নগদ টাকা বিলি প্রক্রিয়ায় এক দল মধ্যস্বত্ত্বভোগী তৈরি হবে, যারা নামের তালিকা তৈরি বা বিলি-বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করবেন।” ফলে এই নয়া ব্যবস্থায় দুর্নীতির নতুন মুখ খুলতে বাধ্য বলে মত প্রাক্তন বাম-মন্ত্রীর। |
|
|
|
|
|