|
|
|
|
জল ঢুকল নবান্নে, কলকাতায় নামল নৌকো |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ফোঁটা ফোঁটা থেকে শুরু হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অঝোর ধারাপাত। হেমন্তের গোড়াতেও এমন নাছোড়বান্দা বৃষ্টির ফল যা হওয়ার, তা-ই হল। জলবন্দি হয়ে পড়ল কলকাতা ও হাওড়া। এমনকী, রীতিমতো ভারী বৃষ্টিতেও কলকাতার যে সব বড় রাস্তায় জল দাঁড়ায় না, সে রকমও বেশ কিছু রাস্তা চলে গেল জলের তলায়। নামাতে হল নৌকো। আর হাওড়ায় জল ঢুকল রাজ্যের প্রধান সচিবালয় নবান্নে। অবস্থা সামলাতে ঘুম উড়ে গেল দুই পুরসভার। অবশেষে দুপুরের পর বৃষ্টি থামার পর কিছুটা স্বস্তি।
শুক্রবার সারাদিন ঝিরঝির বৃষ্টিতেও সচল ছিল সব কিছু। রাতে দুই শহর ঘুমিয়ে পড়ার পর শুরু হয় অবিরাম বৃষ্টি। যা জারি থাকে শনিবার প্রায় দুপুর পর্যন্ত। পুলিশ ও পুরসভা সূত্রের খবর, কলকাতার প্রায় সমস্ত গলি থেকে রাজপথ জলের তলায় চলে যায়। তার মধ্যেই আমহার্স্ট স্ট্রিট, অলিপুর বডিগার্ড লাইন, সিঁথি এবং কসবায় অতিরিক্ত জল জমায় আটটি নৌকো নামাতে হয়। ডুবে যায় ঠনঠনিয়া, গড়িয়াহাট-পঞ্চাননতলা, নারকেলডাঙা, এজেসি বসু রোড এবং সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের বিভিন্ন এলাকা। কোথাও ছিল হাঁটুজল, আবার ঝামাপুকুরের মতো কিছু এলাকায় জল ওঠে কোমর পর্যন্ত। এমনকী ভিআইপি রোডেও জল দাঁড়িয়ে যায়। কসবা ও বেহালা এলাকার কিছু বাসিন্দা জানান, তাঁদের বাড়ির একতলায় জল ঢুকে গিয়েছে। জল ঢুকেছে দক্ষিণ বন্দর থানার ভিতরেও।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এ দিন দুপুরে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম পুরসভার কন্ট্রোল রুমে হাজির থেকে জল নামানোর কাজ তদারক করেন। পথে নেমেও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন তাঁরা। পথে নামেন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থও। এ দিন জল জমার খবর পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী শিলিগুড়ি থেকে মেয়রকে ফোন করে নির্দেশ দেন, রাতভর পুরসভার কন্ট্রোল রুম খোলা রাখতে হবে। রাতে পালা করে থাকতে হবে মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ, দেবাশিস কুমার ও সুশান্ত ঘোষকে। কন্ট্রোল রুমে থাকতে হবে সেচ দফতর এবং কেএমডিএ-এর অফিসারদেরও। সেই সঙ্গে, জল নিকাশির কাজ তদারকের সঙ্গে যুক্ত বিভাগগুলির আধিকারিক ও কর্মীদের ছুটি বাতিলের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। মেয়রকে তিনি বলেন, প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থা থেকে পাম্প ভাড়া করে জল নামানোর কাজে লাগাতে হবে।
পরে মেয়র জানান, টানা দশ ঘণ্টার অতিবৃষ্টিতে (গড়ে ১৫৭ মিলিমিটার) শহরের বহু এলাকায় জল জমেছে। তাই ভোর থেকেই ১৭টি পাম্পিং স্টেশনের নিকাশি পাম্প চালু করে দেওয়া হয়। বর্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় যে সব এলাকা থেকে পোর্টেবেল পাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলি নতুন করে বসানো হয়। এর ফলে বিকেলের মধ্যেই শহরের বেশির ভাগ জায়গা থেকে জল নেমে গিয়েছে। মেয়র জানান, যে সব এলাকায় এখনও জল রয়েছে, সেখানে দ্রুত জল নামানোর চেষ্টা হচ্ছে।
|
কোথায়
|
কত বৃষ্টি (* মিলিমিটার) |
মানিকতলা |
১২৮.৭৫* |
বীরপাড়া |
১৩০ |
ধাপা লক |
১৫০ |
তপসিয়া |
১৫৬ |
উল্টোডাঙা |
১৪৫ |
পামার ব্রিজ |
১৫৭ |
ঠনঠনিয়া |
১৫৯ |
বালিগঞ্জ |
১৩৯ |
মোমিনপুর |
১৪৯ |
চেতলা লক |
১৩৬.৪০ |
যোধপুর পার্ক |
১৩৮ |
কালীঘাট |
১৩২ |
জিঞ্জিরা বাজার |
১৮০ |
বেহালা |
১৭৫ |
(সময়: শুক্রবার রাত ২টো থেকে শনিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত) |
|
পুরমন্ত্রী জানান, সেচমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, দুপুর আড়াইটের মধ্যে শহরের নিকাশি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত গঙ্গার লকগেটগুলি বন্ধ করে দিতে। কারণ, ওই সময় থেকে গঙ্গায় জোয়ার শুরু হয়। লকগেটগুলি বন্ধ না করলে গঙ্গার জলও শহরে ঢুকে পড়ে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে তুলত। তাই দুপুরেই লকগেটগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুরসভার নিকাশি বিভাগের এক কর্তা জানান, লকগেট বন্ধ করার ফলে শহরের বেশির ভাগ এলাকা থেকে দ্রুত জল নেমেছে। তা ছাড়া শহরের ইটের তৈরি নালা নতুন করে লাইনিং করানো হয়েছে গত পুরবোর্ডের আমলে। তারও সুফল মিলেছে। মূলত পুরনো কলকাতার ওই সব এলাকার নিকাশি নালায় পলি জমেনি। তাই জলও নেমেছে। তা ছাড়া, পুরসভাকে সুবিধে করে দিয়ে এ দিন দুপুরের পরে বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে।
এ দিন সন্ধ্যায় শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় ফেরেন মুখ্যমন্ত্রী। দমদম বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে হলদিরাম হয়ে রাজারহাটে ঢোকার মুখে কিছুটা জলে-ডোবা রাস্তা পেয়েছেন তিনি। তবে বাকি রাস্তায় আর জল পাননি। কলকাতার অনেক বাসিন্দাই জানিয়েছেন, বিকেলের পর থেকে তাঁদের এলাকার বড় রাস্তা থেকে জল নেমে গিয়েছে।
তবে হাওড়ার অবস্থা ছিল কলকাতার চেয়ে বেশ খারাপ। বানভাসি হাওড়া ও বালি পুর এলাকার একাধিক ওয়ার্ড। কোথাও দেড় ফুট, কোথাও তিন ফুট জল দাঁড়িয়ে যায়। পুরসভার হিসেবে মোট ৫০টির মধ্যে ২০টি ওয়ার্ড ছিল জলমগ্ন। ছিল। সব থেকে খারাপ অবস্থা ছিল ৬, ৯, ২০ এবং ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের। একই ভাবে বালির ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩ এবং ২৮ থেকে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের ছিল সবচেয়ে বেহাল দশা। হাওড়ারও বহু বাড়িতে জল ঢুকেছে। মন্দিরতলায় নবান্নের সামনে ছিল হাঁটুজল। জল ঢুকেছে ভেতরেও।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাওড়া পুরসভাতেও জঞ্জাল অপসারণ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়। কন্ট্রোল রুমও খোলা থাকে দিনভর। হাওড়া জেলা প্রশাসন থেকে পুরসভার মাধ্যমে জলমগ্ন এলাকাগুলিতে পানীয় জলের পাউচ, চিঁড়ে, গুড় পৌঁছে দেওয়া হয়।
জল-পরিস্থিতি নিয়ে বাম-শাসিত হাওড়া পুরসভার সঙ্গে পুরমন্ত্রীর চাপান-উতোরও দেখা যায় এ দিন। দুপুরে জলবন্দি হাওড়ার ছবি দেখে জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাসের সঙ্গে বৈঠক করেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়। পরে পুরমন্ত্রী অভিযোগ করেন, “হাওড়া পুরসভার পাশে দাঁড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু কলকাতায় যখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ হচ্ছে, তখন হাওড়া পুরসভায় মেয়র, কমিশনার কেউই উপস্থিত নেই। বাম শাসিত এই পুরসভার কর্তৃপক্ষ মানুষের পাশে না দাঁড়ানোয় আমাদেরই লজ্জা হচ্ছে।” এই অবস্থায় জেলাশাসককে তাঁর নির্দেশ, পুরসভা কার দখলে তা দেখার দরকার নেই। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ওয়ার্ডগুলিতে ত্রাণ পৌঁছনো ও পাম্প লাগিয়ে জল বার করার ব্যবস্থা করতে হবে। নবান্নের সামনে জল জমার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর অভিযোগ, “পুরসভা তার দায়িত্ব পালন না করায় পুর দফতরই জমা জল বার করার ব্যবস্থা করছে।”
সিপিএমের মেয়র মমতা জায়সবাল পাল্টা বলেন, “মন্ত্রীর জানা উচিত ছিল, (পুরভোটে) বামফ্রন্ট প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেওয়ার পূর্ব নির্ধারিত দিন ছিল আজ। তাই কিছু সময়ের জন্য আমরা ছিলাম না। কমিশনার আসতে পারেননি কলকাতায় জমা জলের জন্য। কিন্তু জমা জল বার করার জন্য সকাল থেকে ১৫টি পাম্প কাজ করছে।” বালির চেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ী বলেন, “পঞ্চায়েত এলাকায় খালগুলি সংস্কার না হওয়ার জন্যই বালি পুর এলাকার জল বেরোতে পারছে না।”
দুই শহরেই দুপুরে বৃষ্টি থামার পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন সাধারণ মানুষ। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে তাঁরা শঙ্কিতআবার যদি বৃষ্টি নামে, যদি ভেসে যায় গলি থেকে রাজপথ...। |
|
|
|
|
|