চেনা গল্প অচেনা মোচড়
আজ কপাল পুড়ল: পিঁপড়ে ও ঝিঁঝি-র
বিপুলা পৃথ্বীর এক কোণে ছিল একটি জনপদ। সেখানে বাস করতেন এক বিখ্যাত গায়ক। নাম তাঁর ঝিঁঝিটখাম্বাজ। প্রতি দিনই তাঁর গান শুনতে প্রভূত পতঙ্গ-সমাগম হত। আসরে বসে তিনি গান ধরতেন নানা সুর লয় আর তালে। তবে যে গান ধরলে তাঁর শ্রোতাদের বাহ্যজ্ঞান পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যেত, সেটি ঝিঁঝিটখাম্বাজ রাগেই গাওয়া। গানটি, ‘হায় ঝিঁঝিদের কেন ডানা নেই। যদি থাকত ডানা, ঝিঁঝিরা পাখি হত কত সহজেই। হায় ঝিঁঝিদের কেন ডানা নেই...।’
হেমন্তকালেই জন্মেছিলেন এই বিখ্যাত গায়ক। জন্মের পরেই তাঁকে গান শিখিয়েছিলেন তাঁরই বিখ্যাত গায়ক-পিতা মহাঝিঁঝি। গান গাইবার আনন্দে ঝিঁঝিটের মনে সব সময় রঙিন বুদ্বুদ। যত ক্ষণ পারতেন, গেয়ে চলতেন। হেমন্তকালে চারিদিকে ফুলের সমাহার। সেই জানা-অজানা ফুলেদের মধু আর রেণুু খেয়ে-মেখে দিব্যি দিন কেটে যেত ঝিঁঝিটখাম্বাজের। আর খাওয়ার চিন্তা যদি কারও না থাকে, তার পক্ষে অনেক কিছুই সহজে করা সম্ভব। আমাদের ঝিঁঝিটের পক্ষে যেমন, গান।
সে দিনও ঝিঁঝিট তাঁর আসরে বসে গান ধরেছেন উদাত্ত কণ্ঠে। চারিদিকে ‘বাহবা’, ‘এনকোর’, আর শ্রোতাদের ঘন ঘন সিটি। ঝিঁঝিটের মনে হল, শ্রোতাদের এই তুমুল হাততালির মধ্যে স্বর্গে পৌঁছে যাচ্ছেন।
আনন্দের সেই মুহূর্তেই, ধাঁ করে মনে পড়ে গেল, আরে! আমার প্রতিবেশী পিপীলিকা তো কোনও দিন এই আসরে আসেনি! সে রসকষহীন? বর্বর? না কি আমার মতো গায়ককে অবজ্ঞা করছে? শ্রোতাদের কাছে নিজের মনের দুঃখটা চেপে রাখতে পারলেন না। ঝিঁঝিট বললেন, ভাই আরশোলা, ভাই মাকড়সা! গুবরে পোকা ভাই! আমার মনে হয়, তোমাদের আর তেমন আনন্দ দিতে পারছি না। তোমরা গান শুনে বাহবা দিচ্ছ, ঠিকই। তবে সেটা মন থেকে নয়, নেহাত দিতে হয় তাই!
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
শ্রোতারা তো গায়কের এ হেন অভিমানে কাতর! সকলে মিলে কোরাসে বলল, কে বলেছে উস্তাদজি? যত দিন যাচ্ছে, আপনার গলা আরও খোলতাই হচ্ছে। মশা বলল, আমি তো একটু-আধটু গান জানি। কিন্তু আপনার মতো এমন গলা আমার কই? লুকিয়ে মাঝে মাঝে গাই। আর চড়চাপটা খেয়ে পালাই। ভিমরুল বলল, আমার গান শুনেও তো লোকে তাড়া করে। কিন্তু দেখুন, আপনার গান তারা কত মন দিয়ে শোনে!
তখন পিপীলিকা সেই আসরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তার ঘাড়ে একটা মস্ত চিনির দানা। সেটাকে বয়ে আনতেই তার গলদ্ঘর্ম অবস্থা। তাকে দেখিয়ে ঝিঁঝিট বললেন, পিপীলিকার সঙ্গে আমার সারা দিনে অন্তত বাইশ বার চোখাচোখি হয়। সে কি কোনও দিন আমার গান শুনতে এসেছে? মনে হয়, সে আমাকে গায়ক বলে পাত্তা দেয় না! সারা আসর দুয়ো দিতে লাগল পিপীলিকাকে। পিপীলিকা প্রথমে চমকে-টমকে অস্থির! তার মতো ছোটলোককে নিয়ে সংগীতের আসরে কথা হচ্ছে! সে ঝিঁঝিটকে প্রণাম করে বলল, উস্তাদজি! আমি হলাম গিয়ে দিনমজুর। সারা দিন পরিবার নিয়েই মরে আছি। তার ওপরে শীত আসছে। বরফে মাঠঘাট ঢেকে গেলে আর খাবার কোথায় পাব! ও দিকে গিন্নি আবার সতেরো নম্বরটার জন্ম দেবেন ভরা শীতে। আমাকে তো সব ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রোতারা বলল, আরে, সমস্যা তো সকলেরই রয়েছে। বোসো, উস্তাদজির নতুন সুর দেওয়া গানটা শুনে যাও। পিপীলিকা বলল, আমার এখন মরার সময় নেই। আমি ঠিক শীতকালে উস্তাদজির আসরে রোজ হাজিরা দেব ছেলেপুলে সমেত! বাচ্চাগুলোকে একটু ভালমন্দ জ্ঞানের পরিচয় তো দিতে হবে!
কেটে গেল অনেকগুলো দিন। ইতিমধ্যে শীত হানা দিয়েছে। শুকনো ডালপালা ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। ফুলেরা মূূর্ছা গিয়েছে। তাদের উপর ঘন হয়ে জমেছে তুষার। এমন সময় ঝিঁঝিট তাঁর বাসা থেকে বের হয়ে একটা ঢিবির উপর বসে রেওয়াজ শুরু করলেন। ক’দিন ধরে শরীরটা বড় ম্যাজম্যাজ করছে। ফুলের রেণু দূরের কথা, জলবিন্দুও জোটেনি। তবু গান না গেয়ে কি থাকা যায়? ওস্তাদ গাল-গলা ফুলিয়ে সবে গান ধরেছেন, এল হাওয়ার একটা ঝাপটা। ওস্তাদকে উড়িয়ে কয়েকশো গজ দূরে ফেলে দিল! একে কয়েক দিনের অনাহার, তার উপরে এমন বিশাল ধাক্কা! হাড়গোড় ভেঙে ঝিঁঝিট দ’ হয়ে পড়ে রইলেন!
তাঁর এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এল মশা, মাছি, ভিমরুল, আরশোলারা। ওস্তাদকে ঘিরে জটলা শুরু হল। সকলেই তাঁকে এ বার গালিগালাজ করতে শুরু করল। মশা বলল, সারা দিন গান করলে কি হয়? পেটের ধান্দা তো করে রাখতে হবে। এই তো আমাকে দেখো না তোমরা। মানুষ সুযোগ পেলেই আমাকে চপেটাঘাতে সংহার করতে চায়। তা বলে কি আমি তাদের দেহের রক্তশোষণ কম করেছি! আরশোলা বলল, আমাকে তো সব সময় ভাগাড়ের খবর রাখতে হয়। গরু-কুকুর-মানুষ, কে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়? তবু আমি ঠিক খাবার জোগাড় করি। ভিমরুল ঘোঁত-ঘোঁত করে বলল, খাবার জোগাড়েই সবচেয়ে বেশি সময় লাগে, না হলে আমিও ওস্তাদ হতে পারতাম। কিন্তু ঝিঁঝিটকে কে খেতে দেবে, কে তাঁর সেবা করবে? কথা উঠতেই ভিড় পাতলা হয়ে গেল। পিপীলিকা এত ক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। ধরাধরি করে কোমাচ্ছন্ন ঝিঁঝিটকে নিয়ে গেল নিজের বাসায়। বলল, ম্যায় হুঁ না!
পিপীলিকার এই আত্মত্যাগে চারিদিকে ধন্য-ধন্য রব পড়ে গেল। এই প্রচণ্ড শীতে নিজের খাবারের সংস্থানই যেখানে কারও নেই, সেখানে এত বড় গায়কের দায়িত্ব নেওয়া! টিভি চ্যানেল খবরটা টেলিকাস্ট করল। সংবাদপত্রে ফার্স্ট পেজ নিউজ হল। পিপীলিকাকে সংবর্ধনা দিল রাজ্য, দেশ। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা বললেন, এত বড় আত্মত্যাগ করা সহজ নয় এই মাগ্গি-গন্ডার বাজারে। পিপীলিকা পরের সকালে টাইম মেশিনের বোতাম টিপল। দেখল, হাজার বছর পরেও তার এই আত্মত্যাগের কথা পাঠ্যপুস্তকে ছাপা থাকবে। কে এক ইশপ সাহেব এই ঘটনাটাকে নিয়ে গল্প লিখে বলবেন, পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। সবার আগে দরকার পেটের খাবার। সংগীত শিল্পকলা-টলা সব পরে।
পিপীলিকা নিশ্চিন্ত হল। তার এই মহান কীর্তির কথা কালোত্তীর্ণ হবে। হবেই! সে একটা মস্ত বড় করাত দিয়ে ঝিঁঝিটের গলাটা কেটে ফেলল। তার পর অন্তঃপুরের দিকে তাকিয়ে হাঁকল, কই গো গিন্নি! ছেলেপুলেদের নিয়ে এসো। এত ভাল মাংস কোনও দিন খাওনি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.