রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
একটাভয়[কষ্ট]লজ্জাঘেন্না
ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম দেশের বাড়ির কালীপুজোয়। আমি, দিদি আর দাদা। বেশ অনেক ক্ষণ লাগে পৌঁছতে। তাই মোক্ষম টাইমপাস হচ্ছে নানা রকম খাওয়া। দু’বার ঝালমুড়ি, শিঙাড়া, কাঁচাগোল্লা, শশা, চানাচুর মাখা, বেশ কয়েক বার চা। সে বার বছর সাতেক বয়সের একটা কপি-বুক ‘অপু’ তার মা-বাবার সঙ্গে একই কামরায় উঠেছিল। বসেছিল আমাদের পরের রো-এ। বাচ্চাটা অনেক ক্ষণ আমাদের দূর থেকে দেখছিল। মিটিমিটি হাসিও হেসেছে। কখন যেন একটু একটু করে কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। আমরা তখন শিঙাড়া খাচ্ছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘খাবে?’ খুব লজ্জা পেয়ে মাথাটা প্রায় স্থির রেখে একটা ছোট্ট সম্মতি জানাল। হাতে একটা শিঙাড়া দিলাম।
চিকচিক করে ওঠে চোখ দুটো। বার দুয়েক বোধ হয় কামড় দিয়েছে, হঠাৎ ওর মা খোঁজ করলেন ছেলের। এ দিক ও দিক তাকাতেই দেখতে পেলেন, ও আমাদের সঙ্গে শিঙাড়া খাচ্ছে। রাগে চোখ দুটো ঠিকরে উঠল। চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তুমি চেয়েছ?’ প্রায় কাঁদো কাঁদো অপু জবাব দিল, ‘না মা আমি চাইনি, দিদিটা দিয়েছে।’ মা তত ক্ষণে উঠে এসেছেন বসার জায়গা থেকে। ঠাস করে সপাট এক চড়। হাতের শিঙাড়া মাটিতে। হাঁ হাঁ করে উঠি, ‘মারছেন কেন? আমিই দিয়েছি।’ খুব রাগ আর কান্না মেশানো গলায় মায়ের জবাব এল, ‘কিন্তু এখানে এসে দাঁড়াবে কেন?’ ঘা কতক আরও পড়ল। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘আমায় সকাল থেকে খেতে দাওনি কেন? আমার খিদে পায় না?’
মা সিটে ফিরে গিয়ে ব্যাগের চেন খুলে একটা পুরনো মলিন বিস্কুটের প্যাকেট থেকে দুটো মিইয়ে যাওয়া বিস্কুট ঠুসে দিলেন ছেলের মুখে, ‘নে, খা, খা! গিলে আমায় শান্তি দে, উদ্ধার কর।’ ছোট্ট ছেলে, অভিমানে ফুঁসছে তখনও। থু থু করে ফেলে দিয়ে বলল, ‘পচা বিস্কুট খাব না।’ অসহায় বাবা এ বার ছেলেকে কোলে নিয়ে দরজার দিকে চললেন, ‘এই তো বাবা, আর একটু পরেই আমরা নামব, তার পর রিকশা করে সোনাদিদার বাড়ি যাব। সেখানে গিয়ে লুচি খাব, আলুর দম খাব।’ শার্টের হাতা দিয়ে মোছাতে থাকেন ছেলের চোখ। মা মুখ নামিয়ে বসে পড়েন। বুঝতে পারি খুব চেষ্টা করছেন চোখের জল আটকানোর।
আমি যেন এক মুহূর্তে একটা চাবুক খেয়ে বুঝতে পারলাম, দারিদ্রের সবচেয়ে বড় শয়তানি হল, তা আত্মসম্মান ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখন বারো-তেরো বছর কেটে গেছে, তবু যত বার এই মুহূর্তটার কাছে গিয়ে পড়ি, তত বার বড্ড কষ্ট হয়। ওই মায়ের জন্য, ওই বাচ্চাটার তপতপে মনের জন্য, ওই বাবার অসহায়তার জন্য। আর বার বার মনে হয়, এই কষ্টটা কি আমিই দিয়েছিলাম? না কি, আমি নিমিত্ত মাত্র, কিছু না কিছু করে কিছু আগে-পরে এই বেদনাটা ফেটে বেরিয়ে আসতই?
আমি তখন তো সত্যিই বুঝিনি একটা বাচ্চাকে শিঙাড়া খেতে দেওয়া মানে এক জন মায়ের মনে লঙ্কাবাটা ঘষে দেওয়া। তবু বেশ অপরাধী লাগে। জানি না, সেই মায়ের এখনও এই ঘটনাটা মনে আছে কি না। বা ওঁরা এত কষ্ট পান কি না। কিন্তু লঙ্কাবাটার শেয়ার আমার ভাগে কিছু কম হয়নি। কিছু কিছু ব্যথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রং পাল্টায়। রোদ-হাওয়া-জল পেয়ে তাদের রং বদলে কখনও ধূসর, কখনও গাঢ় বাদামি হয় বটে। আর কিছু কিছু ব্যথা আছে যেগুলো এমন তীব্র নীল, সে কথা মনে পড়লে কালশিটে এখনও পড়ে বইকী। মনের ভেতর ছটফট এমন জোরালো হয়ে ওঠে যে নিজেকে ছেড়ে ছুট মারতে ইচ্ছে করে।
আর যখন বোঝা যায় এই ব্যথার দাগ নিয়ে আজীবন থাকতে হবে, কখনও বিয়েবাড়ির ফিশ ফ্রাইয়ে কামড় দিয়ে, কখনও পুজোর বাজার করতে গিয়ে কিংবা কখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে হঠাৎই কোনও নোটিস ছাড়া এই বেয়াড়া শার্প কোনাওয়ালা কষ্টগুলো আছড়ে পড়বে ঠিক আমার বুকের মাঝখানটায়, তখন বড্ড অসহায় লাগতে থাকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.