ম্যাচটা মিনিট কয়েক এগোতেই ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিকের থেকে একটা ইন্টারেস্টিং ফোন বার্সেলোনার দু’জন চিনা প্রেমিক-প্রেমিকা সমর্থক ন্যু কাম্পে-ই এই ম্যাচের আগেই বিয়ে করেছে! বার্সা ম্যানেজমেন্ট নাকি এই অভিনব বিবাহবাসর বাছার অনুমতি দিয়েছিল যুগলকে।
টিভিতে পুরো খেলা দেখার পর মনে হচ্ছে, গ্যালারির মতো মাঠের মধ্যেও কখনও ইনিয়েস্তা-নেইমার, কখনও নেইমার-ফাব্রেগাস, কখনও ফাব্রেগাস-ইনিয়েস্তা ‘বিয়ে’ হল! এই তিন জনের অসাধারণ কম্বিনেশন, বল কন্ট্রোল, গতি, টাচ-এ প্রথম পঁয়তাল্লিশ রিয়াল মাদ্রিদকে নাস্তানাবুদ করেছে বার্সেলোনা।
তিন জনের মধ্যেও আসল লোক নেইমার। এল ক্লাসিকো মানেই ইদানীং তার ক্যাচলাইন মেসি বনাম রোনাল্ডো। কিন্তু শনিবার রাতে দুই সুপারস্টার পুরো নব্বই মিনিট মাঠে থাকা সত্ত্বেও মঞ্চ নিয়ে চলে গেল নেইমার। জীবনের প্রথম এল ক্লাসিকো-র প্রচণ্ড চাপ সামলে, আগাম “আমি এই ম্যাচটায় সেরা পারফর্ম করার জন্য মুখিয়ে আছি” ঘোষণা করে নেইমার নিজের কথা রাখল। একটা একুশ বছরের ছেলের বরফশীতল স্নায়ুর পাশাপাশি দুর্দান্ত স্কিলের এর চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে? এল ক্লাসিকো-র সেরা ক্যাচলাইনের তৃতীয় দাবিদার কিন্তু এসে গেল! |
আসল কাজ করে দিয়েছি। এল ক্লাসিকোয় অভিষেক ম্যাচে
গোল করে যেন সেটাই বলছেন নেইমার। ছবি: এএফপি। |
নেইমারের খেলার প্রত্যেক দিন উন্নতি ঘটছে। প্রতিটা ম্যাচে আগের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। যেমন এ দিন কনফেডারেশনস কাপের চেয়েও নেইমার অনেক বেশি পরিণত ফুটবল খেলেছে। একটা গোল করেছে। অন্য গোলটা করিয়েছে। যদিও নেইমারের পাস থেকে অ্যালেক্সি সাঞ্চেজ ঘাড়ের উপর থাকা ডিফেন্ডারকে টপকানোর ফাঁকেই রিয়াল গোলকিপার লোপেজকে এগিয়ে আসতে দেখে দারুণ বুদ্ধি করে তার মাথার উপর দিয়ে বল গোলে পাঠিয়েছে। প্রথমার্ধে ইনিয়েস্তার পাস থেকে নেইমারের গোলটা রিয়াল ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে গতিপথ পালটে জালে ঢুকলেও শট নেওয়ার আগে নেইমারের বল কন্ট্রোল ছিল দেখবার মতো। আগে নেইমার শুধু ডান দিকে কাটাত। এখন ইনসাইড ড্রিবলও করছে। আর ওর দু’দিকেই ড্রিবলিং সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে ডিফেন্ডাররা। যেমন কোনও পেসার দু’দিকেই বল মুভ করলে তাকে খেলা ব্যাটসম্যানের কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা, ইউরোপিয়ান লিগে খেলতে এসেই নেইমার ডিফেন্ডারের মার সামলেও দুরন্ত স্কিল দেখাচ্ছে। এ দিন মার্সেলো ওকে পরপর দু’বার বিশ্রী মেরে ফেলে দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেইমার গোল করল। পেপে-র টিপিক্যাল মাথাগরম করে দেওয়ার ফাউলেও ঠান্ডা থেকেছে নেইমার।
নেইমারের পাশে মেসি-কে পর্যন্ত তুলনায় ম্লান দেখিয়েছে এই ম্যাচে। হতে পারে মেসি এখনও পুরো ফিট নয়। ম্যাচ প্র্যাক্টিসও কম পেয়েছে। নইলে নেইমারের গোলের পরেই মেসি যে সুযোগটা নষ্ট করল সেটা অন্য দিন হলে নির্ঘাত গোল।
রোনাল্ডো বরং হাফটাইমের পর কিছুটা নিজের জাত চিনিয়েছে। আমার মতে ওই সময় রোনাল্ডো একটা পেনাল্টি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ওকে বার্সা বক্সে করা ফাউলটায় রেফারি পেনাল্টি দিলেও হয়তো প্রশ্ন উঠত না। (বরং খেদিরাকে আটকাতে গিয়ে আদ্রিয়ানোর হ্যান্ডবল ইচ্ছাকৃত নয়। রেফারির পেনাল্টি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক)। বেঞ্জিমা-র একটা শটও পোস্টে লাগে দ্বিতীয়ার্ধে। তার পর নব্বই মিনিটে রদ্রিগেজ একটা গোল শোধ করেছে। সব মিলিয়ে তাই বলা যায়, দ্বিতীয়ার্ধে রিয়ালের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে ম্যাচের ফল হয়তো অন্য রকমও হতে পারত।
তবে ওজিলকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে রোনাল্ডো কেন রিয়াল ম্যানেজমেন্টের উপর রেগে গিয়েছিল, মরসুমের প্রথম এল ক্লাসিকোতেই বোঝা গেল। মাঝমাঠ থেকে ওজিল-ই রোনাল্ডোকে দু’প্রান্তে পাসের পর পাস বাড়াত। ওজিলের অভাবে এই ম্যাচে রিয়াল সারাক্ষণ প্রকৃত বলপ্লেয়ারের অভাবে ভুগেছে। রোনাল্ডো দুর্দান্ত শুটার, হেডার, রানারসব ঠিক আছে, কিন্তু ও বলপ্লেয়ার নয়। কেউ ওকে বল না খাওয়ালে ওর অর্ধেক জারিজুরি শেষ। এ দিন অনেকটা সেটাই হয়েছে। অথচ ন্যু কাম্পে শেষ ছ’টা ম্যাচে রোনাল্ডো আটটা গোল করেছিল। |
এল ক্লাসিকোয় বার্সার দিন। প্রথম গোলের
পর নেইমারকে ঘিরে উচ্ছ্বাস। ছবি: রয়টার্স। |
আর গ্যারেথ বেল? ট্রান্সফারের ইতিহাসে রেকর্ড ৮৫ কোটি টাকায় টটেনহ্যাম থেকে রিয়ালে এ বার সই করা ব্রিটিশ যুবা এত বড় ম্যাচে যতক্ষণ মাঠে ছিল স্রেফ প্যাসেঞ্জার! পুরো ফিট কি না জানি না (এত টাকার ফুটবলারের পুরো ফিটনেস থাকবে না-ই বা কেন)। তবে ওকে প্রথম দলে রাখার কোনও যুক্তি দেখলাম না। ব্রিটিশ ফুটবলারদের এমনিতেই সূক্ষ্ম টাচ কম থাকে। গতি, শটের জোর, টাফনেসএগুলোই বেশি। বেলের গতি ইউরোপিয়ান লিগে বিখ্যাত। কিন্তু এ দিন সেই গতিও দেখা যায়নি। বরং বারকয়েক খুব খারাপ ফাউল করল। উলটো দিকে নেইমার যেমন তার প্রথম এল ক্লাসিকোয় আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে ছিল, বেল এল ক্লাসিকোয় আবির্ভাবে যেন ততটাই টেনশনাক্রান্ত।
গত দু’বছর লা লিগায় চিরশত্রু রিয়ালকে হারাতে পারেনি বার্সেলোনা। এমনকী শেষ পাঁচটা এল ক্লাসিকোর তিনটে জিতেছিল রিয়াল। দু’টো ড্র। বার্সা এ বার লা লিগায় এক নম্বরে থাকলেও শেষ ম্যাচ ড্র করেছিল। দিনকয়েক আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও মিলানকে হারাতে পারেনি। অন্য দিকে রিয়াল এ সপ্তাহেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জুভেন্তাসকে রোনাল্ডোর জোড়া গোলে উড়িয়ে দিয়ে ছন্দে ছিল। কিন্তু এল ক্লাসিকোয় দেখা গেল উলটো ছবি। বলা যায়, ঘরের মাঠে হলেও বার্সা মানসিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় এত বড় ম্যাচটা বার করে নিয়েছে।
যার আসল কৃতিত্ব নেইমারের। এল ক্লাসিকো-র নতুন ধ্রুবতারা। |