|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
অভিমান থেকে গেল
বিচিত্র পথে গেলেও, তাঁর গান সর্বত্রগামী হল না। অথচ সেই সামর্থ্য তাঁর ছিল।
তাঁরই ছিল। তাই অভিমান। আক্ষেপ নয়, অভিমান।
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় |
শেষের কবিতা’ উপন্যাসে লাবণ্যকে ভালবেসে অমিত শিলং পাহাড়ে আটকে যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘শিলং পাহাড়টা অমিতকে রসিয়ে নিয়েছে।’ সংগীতও মান্না দে’কে রসিয়ে নিয়েছে! এই শুনছি ‘লাগা চুনরি মে দাগ’, তার পরই ‘আও টুইস্ট করে’। এই ‘বড় একা লাগে’, তার পরই, ‘কাহারবা নয়, দাদরা বাজাও’। এই ‘ওগো শেষ বিচারের আশায়’, পরেই ‘কুড়ুল করাত নিয়ে পোড়া বরাত নিয়ে, জঙ্গলে জঙ্গলে কাটি কাঠ’। তাঁর গান দিয়েই যদি বলি, ‘মেজাজটাই তো আসল রাজা’!
‘তিলোত্তমা’ ছবিতে ‘গোলাপের অলি আছে’ রেকর্ডিং হবে, রিহার্সাল পাকা, বললাম, মান্নাদা, এ বার রেকর্ড করি? উত্তর, ‘দাঁড়ান মশাই, এখনও দেরি আছে। গানটা ভাল করে গাইতে দিন। রাধুবাবু, (রাধাকান্ত নন্দী) বাজান!’ বলেই তবলার বাণী উচ্চারণ করতে করতে ঝোঁক দিয়েই শুরু করলেন, ‘গোলাপের অলি আছে’। একটানা গেয়ে গেলেন ‘কেউ নেই আমার’ পর্যন্ত। অর্কেস্ট্রেশন ছিল দৃশ্য মাফিক সাদামাঠা, কিন্তু রাজার মেজাজ সামলাতে ওভারটাইম হয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বর্বর বা বনমানুষের মধ্যে মিশেল নেই, মিশেল আছে মানুষের মধ্যে।’ মানুষের বড় সম্পদ তার অনির্বচনীয়তা। সেটা যদি বোধের পরিচয় হয়, তবে শিল্পসৃষ্টি শুধু ‘সঞ্চয়িতা’ হতে পারে না, ‘চলন্তিকা’ও! কেবল সঞ্চিত ধনের সংরক্ষণ নয়, সচলতায় তার সদ্ব্যবহার।
এই জীবন ও সংগীতবোধই মান্নাদা’র শিল্পীসত্তার একশো ভাগ ঐশ্বর্য! কোনও সাংগীতিক রক্ষণশীলতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। আমার ‘জীবনরহস্য’ ছবির গান ‘কে তুমি শুধুই ডাকো’য় সারা গানে বৃন্দাবনী সারঙের নামগন্ধ নেই। কিন্তু আমার প্রিল্যুডে কেবল বৃন্দাবনী সারঙ দিয়ে কিছু স্বরগ্রাম উচ্চারণ করানোর ইচ্ছে হল। কাজটা করলাম, কিন্তু মান্নাদা এই নিয়ে এক বারও প্রশ্ন তুললেন না যে মূল সুরের সঙ্গে এই তানের সঙ্গতি কী? অবলীলায় সানন্দে মেজাজটাকে আসল রাজা করেই গেয়ে দিলেন। সাংগীতিক সংমিশ্রণ তাঁর খুব পছন্দের বিষয়। সেই মিশ্রণকে নান্দনিক ভাবে প্রয়োগ করতে তিনি বরাবরই সুদক্ষ। |
|
পাকা জহুরি জহর চিনতে ভুল করেন না। রাজ কপূরের নিজের প্রোডাকশনের ছবি ‘একদিন রাত্রে’। তাতে একটি মাতালের চরিত্রে অভিনয় করছেন বিখ্যাত নট ছবি বিশ্বাস। তাঁর মুখে গান। জীবনদর্শনের কথা, কিন্তু প্রকাশে চটুল। বম্বেতে তখন মাতালের মুখের গান মানেই মহম্মদ রফি। সলিলদা নিজেও ‘দো বিঘা জমিন’-এ জনি ওয়াকারের মুখে রফিকেই গাইয়েছিলেন। কিন্তু ‘এই দুনিয়ায় ভাই’ গানটি দর্শনসমৃদ্ধ, আর চরিত্রাভিনেতা ছবি বিশ্বাস, সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ছবি বিশ্বাস। তাই বোধহয় সলিল চৌধুরী নিলেন মান্না দে’কে। এর পর বাংলা ছবিতে মাতালের মুখে গানে মান্না দে’কে নির্বাচন না-করার বুকের পাটা আর কারও রইল না! দীনেন গুপ্তর শেষ ছবি ‘ঋণমুক্তি’তে আমিও এক মাতালের মুখের গান গাওয়াতে মান্নাদা’র শরণাপন্ন হলাম। পরিণত বয়সের নবযুবক মান্না দে সিঁড়ি দিয়ে তড়াক তড়াক করে লাফিয়ে দোতলায় ‘ওম’ স্টুডিয়োতে প্রবেশ করলেন। উনি মাতালের চূড়ান্ত ম্যানারিজম-এ অ্যালায়েড গিমিক-এ গানটি গেয়ে সমস্ত যন্ত্রীকে তো বটেই, ফ্লোরে উপস্থিত অন্য মানুষদেরও নাচিয়ে, হাসিয়ে মাতিয়ে দিয়ে চলে গেলেন! দীনেনবাবু বললেন, ‘অভিজিৎবাবু, এর পরে আর ছবিতে এ ধরনের গান রাখা যাবে না। বিকল্প পাওয়া যাবে না যে!’
‘আনন্দ’ ছবিতে আনন্দ যখন স্ফূর্তিবাজ বা বেদনাকাতর, তখন রাজেশ খন্নার লিপে মুকেশজি। কিন্তু যেই জীবনদর্শনের কথা এল, ‘জিন্দগি ক্যায়সে হ্যায় পহেলি’, তখন সলিলদা সে গান দিলেন মান্না দে’কে! ‘দো বিঘা জমিন’-এ চাষি যখন জমিহারা হয়ে নগরে রিকশা টানতে এল, সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের গান ‘মৌসম বিতা যায়’ গাওয়ালেন মান্না দে’কে দিয়ে। ‘কাবুলিওয়ালা’য় পশতু সুরে ফেলে আসা দেশের টান-মাখা ‘অ্যায় মেরে প্যারে বতন’ গানটির জন্যও নির্বাচন করলেন সেই মান্না দে-কেই! হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকা সত্ত্বেও তাঁকে না ডেকে মান্না দে’কেই বার বার ডাকলেন। অথচ সলিলদা’র নিজেরই উক্তি, ‘হোয়েন লতা অ্যান্ড হেমন্তদা ইজ মাই আর্টিস্ট, স্কাই ইজ মাই লিমিট!’ উত্তর খোঁজা জরুরি।
একই রকম পাকা জহুরি সুধীন দাশগুপ্ত। মান্নাদা যখন বম্বেতে প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু নিজস্ব আইডেন্টিটির জন্য নয়, তখন কলকাতায় তাবড় তাবড় জনপ্রিয় সফল গায়ক থাকা সত্ত্বেও কেন যে সুধীন দাশগুপ্তর মনে হয়েছিল, ‘ডাকহরকরা’র ‘শেষ বিচারের আশায়’ বা ‘লালপাগুড়ি বেঁধে মাথে’র জন্য যোগ্যতম মান্না দে! ভাবলে অবাক লাগে, কত সূক্ষ্ম এই নির্বাচন! আর সেই বোধ সত্য হয়েই ইতিহাস হল, যা থেকে বাংলা গানে অনেক বৈচিত্রময় অধ্যায়ের সংযুক্তি। ‘ডাকহরকরা’য় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে যখন সম্ভ্রান্ত নায়ক উত্তমকুমার, তখন একই কণ্ঠের ভিন্ন আস্বাদন, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’! আবার জীবন রকে চলে এসেছে, তখনও ‘জীবনে কী পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা’। এসেছে দুষ্টুমির গান ‘আমি কোন পথে যে চলি’, খেয়ালের বন্দিশে ‘বসন্তবিলাপ’ ছবির গান, আবার বাংলার শাশ্বত ধারায় ‘কী আনন্দ’!
সলিলদা, সুধীনদা মান্না দে’কে আমাদের কাছে পৌঁছে দিলেন, চিনিয়ে দিলেন। তখন আমরা সবাই তাঁর উৎকর্ষ কাজে লাগিয়েছি। নচিদা, আমি, অসীমা মুখোপাধ্যায়, মৃণাল, অজয়, সুপর্ণ সবাই। ওই কণ্ঠে এত বৈচিত্র গোপন ছিল, তা প্রাথমিক ভাবে চেনান দুই বন্ধু সলিল আর সুধীন। শুনছি, ‘সবে যখন আকাশ জুড়ে/ মেঘ জমেছে/ ঝড় ওঠেনি, বাতাসটাতে/ ঘোর লেগেছে/ ও কেন তখন উড়িয়ে আঁচল/ খোলা চুলে বাইরে এল!/ দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই/ আমি তো মানুষ!’ পুলকবাবুর অসাধারণ সব লিরিক, সুরকারদের স্নায়ুরক্তের সঙ্গে যিনি পরিচিত ছিলেন। কোন বাণী কার সুরে ফুটবে, এ বোধ তাঁর সহজাত ছিল। ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’ তাই পৌঁছে যায়নি মান্না দে-র কাছে আর ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’ পৌঁছে যায়নি হেমন্তদা-র কাছে। বাণীটা আমার কাছে পৌঁছলে আমি কি এই কাওয়ালি ঢঙে গানটা নির্মাণের কথা ভাবতে পারতাম? না, এক্কেবারে না। কবে একটা কাওয়ালি ঢঙে রচিত হয়েছিল, ‘আমি বনফুল গো’, এত দিন পরে আবার সেই প্রয়োগ। কিন্তু এ প্রয়োগ অনেক অভিজাত, অনেক বিস্ময়কর।
মান্নাদা, আপনার কাছে অনেক পেয়েছি। অনেক শিখেছি। কিন্তু জানেন তো, বস্তুর অভাব বস্তু দিয়ে মেটানো যায়, ভাবের অভাব কোনও দিন মেটে না। ভাবের অনন্ত ক্ষুধা। স্বয়ং বিশ্বকবি বিশ্বজয় করেও মেটাতে পারেননি সেই অসম্পূর্ণতা। ‘ঐকতান’ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন, ‘আমার কবিতা জানি আমি/ গেলেও বিচিত্র পথে/ হয় নাই সর্বত্রগামী।’
আমরাও আশা করেছিলাম গিমিক সং একজিকিউশন-এর রাজা মান্না দে-র মুখে একটা ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম’ শুনব। কিন্তু শুনতে পেলাম না। স্বর্ণযুগের প্রবল প্রবাহে সংগীতে যে আলোড়ন, মেহনতি মানুষের জীবনের কথাও গানে আছড়ে পড়ল, রানার, রিকশাওয়ালাতে। যে সংগ্রাম সঙ্গীতের মধ্যে সৃষ্টি করল সংগ্রামের মন্দ্র মন্ত্রের ধ্বনি, অবাক পৃথিবী-তে। মাটির গানের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম না আপনার মতো মহান শিল্পীর কণ্ঠে, এটা আমার আক্ষেপ নয়, অভিমান। ‘দো বিঘা জমিন’-এ জমিহারা কৃষকের গান ‘মৌসম বিতা যায়’ তো আপনিই গেয়েছিলেন। আরও একটা আপশোস আছে, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ দিয়ে যে কবিতায় সুর রচনা শুরু তার ধারা আজও চলছে, সেই সব কাব্যগীতি ধ্বনিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে, কত না শিল্পীর কণ্ঠে। অথচ আপনি এত বড় সুরের কান্ডারি হয়ে সেই বিশেষ ধারায় আপনার ময়ূরপঙ্খী বাইলেন না।
ইতিহাসের কয়েকটা পাতা সাদা রয়ে গেল। |
|
|
|
|
|