প্রবন্ধ ২...
ম্যাজিক? কখনও না, এ হল সাধনা

প্রায় পঞ্চাশ বছরের আগের এক বিকেলবেলা। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না মান্না দে। কিশোরের সঙ্গে আগেও ডুয়েট গেয়েছেন, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’তে। সারা ভারত মুগ্ধ হয়েছে সে গানে। কিন্তু, জানেন তিনি, কিশোরকুমার যখন নিজের খোলা গলায় গান ধরবেন, তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের পালিশি গায়কি ডুবে গেলেও, যেতে পারে। চোখ বুজে স্মরণ করলেন তাঁর বীজমন্ত্র। পরিশ্রম। ঘন ঘন বসলেন পঞ্চমের সঙ্গে। ঠিক যেমন তাঁর স্বভাব, দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। তাঁর ভাগের সুরসপ্তকে ফাঁকফোকর কোথায় আছে? কোনখানে খেলানো যাবে গলা, দেখানো যাবে রাগসংগীতের কামাল, গুঁজে দেওয়া যাবে নিজের ছোট্ট ছোট্ট কাজ?
ডুয়েল চলেছিল সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা। যন্ত্রীরা ভিড় জমিয়েছিলেন স্টুডিয়োয়। সব্বাই জানতেন, দুই মহারথীকে লড়িয়ে দিয়েছেন পঞ্চম। চোখের সামনে তখন ইতিহাস জ্যান্ত। বলিউড পাড়া সে দিন বিজলিস্পৃষ্ট হয়েছিল। তার পরেও অর্ধ শতক ধরে ভারতবর্ষ হাঁয়ের তস্য হাঁ হয়ে শুনেই গিয়েছে সেই জাদুর লড়াই। পড়োশন-এর জানলায়। এক গানের দুই রং। এক জন গলায় যেন উৎসব হয়ে চলেছে, ঢাক বাজছে, মেলায় মানুষ প্রাণ খুলে দুঃখ ভুলে আনন্দে বুঁদ, মাথার ওপরে শরতের ঝলমলে রোদ্দুর। আর অন্য জন তপস্যারত, পুজো করছেন সংগীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর। ভগীরথের মতো নতমস্তকে সুরের নদীকে নিয়ে চলেছেন নিজের গতিপথে, রাস্তা দেখাতে দেখাতে। এক চতুর নার করকে শিঙ্গার মেরে মন কে দোয়ার মে ঘুসত যাত... শ্রোতা আর না থাকতে পেরে সেই ভাবেই গানটি ধরতে গিয়েই, ফাঁসত যাত... মজার গান, অথচ দাঁত ফোটানো যায় না! হবে না? গায়কটি তো গান গাইছেন না, আসলে ঘন জঙ্গলের প্রত্যন্ত দুর্গম গুহামধ্যে যুগের পর যুগ কঠোর সাধনা করে চলেছেন দেবী সরস্বতীর।
দ্বৈরথ। মান্না দে ও কিশোরকুমার।
নইলে আর কীসের বরপুত্র? সেই কোন দূর শৈশবে, যখন সারেগামা-র পাঠই শুরু হয়নি, যখন ঘুড়ির পিছনে ছুটছেন ছাদ ডিঙিয়ে, বল পিটিয়ে কাচ ভাঙা চলছে, এমন সময় কানে ভেসে এল মহাসংগীত। ছোটকাকা, সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে’র দরজার আড়াল থেকে। সেখানে চলেছে কোনও ভারতখ্যাত সুরের বাদশার আলাপ। ব্যস, খসে পড়ল ব্যাট, সে মন্ত্রাবিষ্টের মতো গলায় অক্লেশে তুলে নিল দুরূহতম কোনও স্বরলিপি। ওস্তাদজির বিদায়মাত্র তাঁর ত্রিশ বছরের সাধনায় আয়ত্তাধীন বোল তবলায় বাজাতে বসল অবলীলায়। দরজা থেকে হন্তদন্ত ফিরলেন ফিদা হোসেন খাঁ। ‘কোন বজাতা হ্যায়? কোন শিখা এ বোল?’
মোটেও ম্যাজিক দেখায়নি সেই বালক। সে দীর্ঘ দিন লেগে থেকে, পড়ে থেকে, শিখে নিয়েছে। তাক লাগানোর শুরু সেই ছেলেবেলাতেই। তার পরে তো কেটেছে বেশ কয়েক দশক। তখন শাস্ত্রীয় সংগীতের ছায়ায় বা রাগ ওলটপালট করে যত গান বাঁধা হয়েছে, যে গানে আছে তাল ছন্দ লয়ের ঘূর্ণিবাজি, সেখানেই রংবাজি দেখিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন এই বাঙালিবাবু। ‘লাগা চুনরিমে দাগ’-এ স্কেল বদলে বদলে আনকোরা রাস্তা দেখাচ্ছেন, রাগাশ্রিত টাইফুন ‘বলো রাধা হতে পারে ক’জনা’য় সুরকে যেখানে সেখানে স্ট্যাচু করছেন, ফের লাট্টুপাক খাওয়াচ্ছেন উড়িয়ে। ‘তুম না তুম না তানা তুম তানানানা’ বলে তাকে এভারেস্টের তুষারঝড়ে তুলে আবার নামিয়ে দিচ্ছেন ‘বাজে গো বীণা’র শহুরে জীবনে।
কাট টু দু হাজার তেরো। রাজত্ব করছে সর্বজান্তা, সর্ববিষয়পটীয়ান ও মহান পক্ব নবীন বঙ্গ। জাতিতে সদাহুজুগময়। অতএব মান্না দে-র মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঢোল-করতাল সমেত শোক-উৎসব উদ্যাপন শুরু হয়ে গেল। চ্যানেলে চ্যানেলে তুমুল উচ্ছ্বাসে গান-টান বাজিয়ে ঘোষণা: আজ একটি বিশেষ দিন। শুনে, গায়কের জন্মদিন না মৃত্যুদিন সম্পূর্ণ গুলিয়ে গেল। একাদশীর ক’দিন পর ইন্টারনেটে জ্যাম লাগল। আবার। এত দিন চলছিল দুর্গাপুজোর ছবির প্রদর্শনী। এ বার শুরু হল লহ প্রণাম শো। আইপ্যাডে, পিসি’তে, মোবাইল ফোনে খটাখট প্রণাম পড়তে লাগল। তবে ফুল-পাতাটা আশ্চর্য রকম লিমিটেড। হয় ‘কফি হাউসের সেই...’ নয়তো ‘...সে নাম রয়ে যাবে’। কারণ এক, প্রণামরত গদগদচিত্তদের বেশির ভাগই ওই দুটি গান ছাড়া মান্না দে’কে মনে করতে পারছে না এবং কারণ দুই, ‘দেখ দেখ আমি কেমন জানি মান্না দে কিশোর-হেমন্ত-রফি লেভেলের বিরাট শিল্পী!’ তবে তিন নম্বরটাই আসল কারণ। মান্না দে’র বিস্ময়-আসরে ঢোকার ক্ষমতা এদের নেই।
সেখানেই দ্য গ্রেট ভানুমতীর খেল। ওই গান শুনতে বেশ। কিন্তু গাইতে এবং বুঝতেও বিকট শক্ত। চটুল টুইস্ট তবু গলা মেলানো যায় না, ঠিক যেমন মজার গান অথচ গাওয়া যায় না, প্রেমের গান অথচ গুনগুন করে সুখ পেতে গেলেই সমূহ বিপদ। ওখানেই তো তিনি সুরের রাজামশাই। জটিল আবেগ আর কঠিন সুরেদের শাসন করে সাধারণ প্রজা বানিয়ে দিতেন তিনি। অসীম শক্তি ওই রেওয়াজি স্বরযন্ত্রে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, শ্রদ্ধা করার কমপ্লিট রাইট জনগণের আছে ভাই। তবে বলি কী, এই জলসাঘরে ঢুকতে গেলে, ওই মারাত্মক শ্রমে অর্জিত গানগুলোর রসাস্বাদন করতে গেলে, শ্রোতা ও সমঝদারেরও একটা ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে। আর সেই যোগ্যতাটাও পরিশ্রম ছাড়া অর্জন করা যায় না।
ওরে বাবা! পরিশ্রম? তার চেয়ে বরং তক্কে তক্কে থাকি, আজ না হোক কাল আবার একটা হুজুগ তৈরি হবে, অমনি আবার ফেসবুকে তুফান তোলা যাবে। ফেনার তুফান।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.