জেম্স বন্ড-এর সৃষ্টিকর্তা আয়ান ফ্লেমিং-এর মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, অথচ বন্ড-কে নায়ক করিয়া সাম্প্রতিকতম উপন্যাসটি সদ্য প্রকাশিত হইবে। লিখিয়াছেন এক প্রতিষ্ঠিত আধুনিক থ্রিলার-লেখক। কিছু দিনের মধ্যেই প্রকাশ পাইবে শার্লক হোম্স বা এরকুল পোয়রো-র নূতন রহস্যকাহিনি। বিভিন্ন প্রকাশকের আস্তানা হইতে বিভিন্ন কিংবদন্তি চরিত্রের নূতন কাহিনি সৃষ্ট হইতেছে। বিখ্যাত কাহিনির পুনর্নির্মাণও চলিতেছে। জেন অস্টেন-এর ‘এমা’, ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ নূতন করিয়া লিখা হইতেছে, আধুনিক পরিস্থিতিতে চরিত্র ও ঘটনাগুলিকে ফেলিয়া। পি জি উডহাউসের বিশ্বখ্যাত চরিত্র জিভ্স-কে নায়ক করিয়া এক নূতন গ্রন্থও আসন্ন। প্রশ্ন হইল, একটি কাহিনি/চরিত্র কি তাহার স্রষ্টা লেখকের ব্যক্তিত্ব, মনন, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজস্ব লিখনশৈলীর মিশ্রণ নহে? যখন কেহ হোম্স পড়িতেছে, সে কি আর্থার কোনান ডয়েলকেও পড়িতেছে না? ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর সহিত কি টলস্টয়ের মৌলিক দর্শন ওতপ্রোত নাই? রবীন্দ্রনাথের গদ্য ব্যতীত কি ‘গোরা’ নির্মাণ সম্ভব, বা জীবনানন্দের গদ্য ব্যতীত ‘মাল্যবান’? বিখ্যাত চরিত্রকে ধরিয়া সম্পূর্ণ আনকোরা গড়নে ও ধরনে কাহিনি বয়ন শুরু করিলে, সেই প্রচেষ্টা শেষ অবধি ওই চরিত্র ও তাহাকে ঘিরিয়া গঠিত মুগ্ধতার বলয়কে অপমানই করিতেছে না কি? উত্তরে প্রকাশকরা বোধ হয় মুচকি হাসিতেছেন ও ব্যবসায়ের রসিদ বাহির করিতেছেন। ভাবিতেছেন, চরিত্রগুলির ভুবনব্যাপী জনপ্রিয়তায় চড়িয়া এই আপত্তিসাগর অনায়াসে অতিক্রম করিবেন। কিংবা হয়তো ভাবগম্ভীর বদনে বলিতেছেন, লেখক চলিয়া যায়, চরিত্র রহিয়া যায়। তাহাদের কি পুনরায় খেলা জমাইতে সাধ যায় না?
ইহাও ভাবিবার, কোনও শিল্প যে মুহূর্তে গণমুগ্ধতা ও প্রবল প্রতিষ্ঠার ফলে প্রায় পূজনীয় ও প্রতিষ্ঠানপ্রতিম অবস্থান পাইয়া যায়, তখন তাহাকে লইয়া নানাবিধ নূতন গড়াপিটা করিবার প্রয়াস আধুনিকতার এক প্রিয় ক্রীড়া হইবে না কেন। ওই ‘প্রশ্নাতীত’ স্তরে উঠিয়া যাওয়া শিল্পবস্তুকেই যদি প্রশ্ন না করিলাম, তাহার সন্তরণ-ট্রফিগুলি কাড়িয়া সম্পূর্ণ নূতন জলে ফেলিয়া না দিলাম, তবে কোন মূর্তি ভাঙিব, কোন প্রতিমার ওষ্ঠোপরি গোঁফ আঁকিয়া দিব? সাহিত্য ব্যতীত, শিল্পের সকল শাখাতেই এই অভ্যাসটি স্বীকৃত। মোনালিসার গোঁফ আঁকিয়া বিশ্বখ্যাত চিত্র-কাণ্ড হইয়াছে, দালি মাতিস-এর বিখ্যাত চিত্রকে নূতন উপাদান জুড়িয়া সকৌতুকে আঁকিয়াছেন। বহু বিখ্যাত গান কত শিল্পী কত প্রকারে গাহিয়াছেন, রবীন্দ্রসংগীতকে ভাঙিয়াচুরিয়া গায়ক ও সংগীত পরিচালকেরা ক্রমাগত বিতর্ক ও প্রশংসা কুড়াইতেছেন, সম্প্রতি রবীন্দ্রগানের ফাঁকে নূতন কথা যোগ করিয়া ‘ইনস্টলেশন সংগীত’ও তৈয়ার হইয়াছে। শেক্সপিয়রের তো রেহাই নাই, প্রতিটি নাটকেরই বোধ হয় বিভিন্ন যুগে বৈপ্লবিক পরিবেশন হইয়াছে, এই ম্যাকবেথ লইয়া স্পুফ হইল, ওই রিচার্ড থ্রি নারীবর্জিত ভাবে অভিনীত হইল। চলচ্চিত্রে ‘রিমেক’ এক অতিপরিচিত কথা, পাশ্চাত্যে প্রায় সকল খ্যাত ছবিরই একাধিক বয়ান প্রচলিত, বাংলায় সম্প্রতি ‘অটোগ্রাফ’ বাঙালির অতিপ্রিয় ‘নায়ক’ অবলম্বনে নির্মিত। সকল ক্ষেত্রে যদি পূর্বসূরিকে আহরণ অবলম্বন আক্রমণ ও পুনর্ব্যাখ্যা পুনরাবিষ্কার সম্ভব, সাহিত্য কোন গুরুঠাকুর যে তাহাকে দূর হইতে বারংবার গড় করিতে হইবে? মহাভারতের আরম্ভেই লিখা রহিয়াছে যে এই কাব্য যুগে যুগে বহু কবি নূতন করিয়া শুনাইবেন, এই মুহূর্তেই ভারতে অত্যধিক জনপ্রিয় সিরিয়াল হইল নূতন এক মহাভারত। এমন মহাকাব্যকেই যদি নিজের মতো করিয়া উলটাইয়া পালটাইয়া ফেলা যায়, বিখ্যাত বিশ্লেষণে বিদুরকে যুধিষ্ঠিরের পিতা বলিয়া আখ্যান সাজানো যায়, রামায়ণ মন্থন করিয়া রামকে খলনায়ক বানাইয়া মেঘনাদবধ কাব্য লিখা যায়, তবে নূতন একটি জেম্স বন্ডের অ্যাডভেঞ্চার লিখিলে কোন পূজাপদ্ধতি অশুদ্ধ হইল? |