স্বজন হারালে যে শোকটা হয়, বৃহস্পতিবার সাত সকালের ফোনে ঠিক সেই শোকই পেয়েছিলেন সঞ্জিত সরকার। খবর পেয়েছিলেন, মান্না দে আর নেই! মনটা যেন এক লহমায় শূন্য হয়ে পড়েছিল।
আসলে মান্না দে স্রেফ তাঁর কাছে এক প্রবাদপ্রতিম গায়ক নন। শিল্পীর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কও নেই। তবু, মান্নাবাবু তাঁর খুবই কাছের মানুষ। মনের মানুষ। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা, এই আপ্তবাক্য সম্বল করে নিজের ঘরেই গড়ে তুলেছেন মান্না দে-র মিনি সংগ্রহশালা। পুরনো গ্রামোফোনের লং প্লেয়িং রেকর্ড, ছোট রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি থেকে শুরু করে মান্না দে-কে নিয়ে নানান লেখাকী নেই পুরুলিয়া শহরের কালীকৃষ্ণ রায় লেনের বাসিন্দা সঞ্জিতবাবুর সংগ্রহে! কিংবদন্তি গায়কের বিভিন্ন ছবিতে ঠাসা সেই সংগ্রহালয়। এমনও হয়েছে কোথাও যাচ্ছেন, রাস্তায় কোথাও মান্না দে-র গান বাজছে শুনতে পেলেন। গান শুনেই বুঝলেন এটা তাঁর সংগ্রহে নেই। গানের উৎস খুঁজে কোন রেকর্ড বা কোন ক্যাসেটের গান জেনে নিয়ে, তা নিজের সংগ্রহশালায় সংযোজিত করেছেন সঞ্জিতবাবু। পারিবারিক অ্যালবামে শিল্পীর সঙ্গে রয়েছে তাঁর একাধিক ছবি।
রেকর্ডে বাজছে, ‘তুমি এক জনই শুধু বন্ধু আমার, শত্রুও তুমি এক জন। তাই তোমাকেই ভাল লাগে।’ ধরা গলায় বললেন সঞ্জিতবাবু, “শরীরটা খারাপ ছিলই। হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন। এই তো কিছু দিন আগে কাগজে খবর দেখলাম যে, অবস্থা স্থিতিশীল। মাঝে মাঝেই রাতে শুয়ে দুশ্চিন্তা হত। কিন্তু, এ দিনই যে দুঃসংবাদটা পাব ভাবিনি!” |
জানালেন, বাবার সঙ্গে হাওড়ার শিবপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে আলাপ মান্না দে-র সঙ্গে। পরে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পুরুলিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে সেই আলাপ আরও জমাট বাঁধে। বলে চলেন সঞ্জিতবাবু, “আমাদের আদি বাড়ি দুর্গাপুরের লোহাগুড়ি গ্রামে। বাবা কমলাকান্ত সরকার সঙ্গীতচর্চা করতেন। ছিলেন মান্না-ভক্ত। বাবার কর্মসূত্রে আমরা তখন বিহারের (অধুনা ঝাড়খণ্ড) ভোজুডিতে থাকতাম। একবার উনি সিঁদরিতে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন। সেই প্রথম শুনেছিলাম ওঁর গান। তখন আমি খুবই ছোট।”
তার পর সময় গড়িয়েছে। সঞ্জিতবাবু বাস্তুকারের পেশায় যোগ দিয়েছেন। কিন্তু, মান্না দে-র সঙ্গে যোগাযোগ দৃঢ় হয়েছে। “দক্ষিণবঙ্গে কোনও অনুষ্ঠান হলে স্বয়ং শিল্পীর কাছ থেকে সেই অনুষ্ঠানে যাওয়ার ডাক আসেনি, এমন হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। উনি আমাকে সঞ্জু বলতেন, আর আমি কাকা বলতাম। রেওয়াজের সময় বেশ কয়েক বার আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছে।”বললেন জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের এই কর্মী। একবার আসানসোলের ভারতী ভবনে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন মান্না দে। একটা ওষুধ প্রয়োজন হয়েছিল, যাতে রাতে একটু নিশ্চিন্ত ঘুম হয়। সঞ্জিতবাবু তাঁর পরিচিত এক জনের ওষুধের দোকানে শিল্পীকে নিয়ে যান। দোকানদার কিছুতেই দাম নেবেন না। আর মান্নাবাবু নাছোড়বান্দা, দাম দেবেনই। শেষে দাম দিলেনই।
মশা নাকি বিলকুল না-পসন্দ ছিল প্রয়াত শিল্পীর, জানালেন সঞ্জিতবাবু। স্মৃতি হাতড়ে ডুব দেন ২০০৪ সালের এক শীতের সকালে। মান্না দে পুরুলিয়ায় অনুষ্ঠান করতে এসে তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন। তখনও এ ভাবে একতলা-দোতলা জুড়ে শিল্পীর নানা সংগ্রহ দিয়ে ভরিয়ে তুলতে পারেননি ঘর। সঞ্জিতবাবুর কথায়, “তবু কাকা দেখে গিয়েছিলেন। পটল খেতে খুব ভালোবাসতেন। আর প্রিয় ছিল লুচি-আলুর দম। আমার বাড়িতে তাই খাইয়েছিলাম।”
বৃহস্পতিবার সকালে দুঃসংবাদ পাওয়ার পরে অফিসে যাননি জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের এই কর্মী। বললেন, “মোবাইল বন্ধ করে রেখেছি। কিছুই ভালো লাগছে না। কত কথাই মনে পড়ছে। উনি মিতব্যয়ী ছিলেন। ওঁর কলকাতার বাড়িতে গেলে বলতেন, ‘তোমার কত খরচ হয়েছে আসতে।’ কখনও ট্যাক্সিতে এসেছি জানলে বলতেন, ‘অটো করে তো আসতে পারতে।’ এমনই ছিলেন কাকা। আর কোনও দিন ওই গলা ফোনে শুনতে পাব না।” লং প্লেতে তখন বাজছে, ‘তুমি অনেক যত্ন করে দুঃখ দিতে চেয়েছ।’ |