যাহা নিষিদ্ধ, বেআইনি, তাহার প্রতি মানুষের আসক্তি কেন? নিষিদ্ধ ফলের আস্বাদ চাখিয়া দেখিবার আদি কৌতূহল হয়তো এক কারণ। কিন্তু আরও বড় কারণ ইহাই যে, মানুষ যাহা কামনা করে, তাহার আইনসম্মত সরবরাহ বন্ধ করিলে বেআইনি কারবার উৎসাহিত হয়। উপরন্তু বস্তুটি যদি সুলভ বা সহজলভ্য হয়, তবে সেই আসক্তির পরিপুষ্টির সম্ভাবনাও বহু গুণ বাড়িয়া যায়। দৃষ্টান্ত: চোলাই মদ। চোলাইয়ের দাম কম, তাহা স্বল্প পরিমাণেও সুলভ, আস্ত বোতল কিনিতে হয় না। দরিদ্র জনসাধারণ নেশাতৃষ্ণা মিটাইতে তাই চোলাইয়ের দিকেই ঝোঁকেন বেশি। পরিণামে মাঝে মাঝেই ঘটিতে থাকে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা। এই প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার দেশি মদ ছোট ছোট প্যাকেটে বিক্রয়ের যে সিদ্ধান্ত লইয়াছে, তাহা ইতিবাচক।
প্রথমত, ইহার ফলে চোলাই বা বেআইনি, অশোধিত, বিষাক্ত আসবের প্রতি টান কমিবে। দ্বিতীয়ত, ইহার ফলে দেশি মদের বিক্রয় বৃদ্ধি পাওয়ায় আবগারি-শুল্ক বাবদে সরকারের আয় বাড়িবে। অন্য কোনও কোনও রাজ্যে ইতিমধ্যেই তাহা ঘটিয়াছে। বস্তুত, এই সিদ্ধান্ত আরও আগেই কাম্য ছিল। মদের ব্যবসায় যুক্তি মানিবার ক্ষেত্রে এত কাল সরকারের যে দ্বিধা দেখা গিয়াছে, তাহা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের আবেগ কিংবা ভ্রান্ত নৈতিকতার (ইহার ফলে জনসাধারণকে মদ্যপানে উৎসাহিত করা হইবে না তো!) সহিত যুক্ত। যুক্তি বলে, যাঁহারা মদ্যপান করিতে চাহেন, তাঁহারা করিবেনই, সস্তায় দেশি মদ সুলভ না হইলে বেআইনি চোলাই মদ পান করিবেন। তাহাতে ঝুঁকি অনেক বেশি, বিপদও। উপরন্তু তাহাতে বেআইনি মদ-ব্যবসায়ীদের মুনাফা। তাহার পরিবর্তে স্বীকৃত পানীয় যদি ক্রেতা-বান্ধব উপায়ে বাজারে বিক্রয় করা হয়, তাহা সর্বার্থেই শ্রেয়। সরকারি সিদ্ধান্তটি সংকেত দেয় যে, প্রশাসনিক ক্রিয়াকাণ্ডে যুক্তির ভূমিকা বাড়িতেছে। রাজ্য সরকারের অনেক ক্রিয়াকলাপেই ইদানীং এ ধরনের সংকেত মিলিতেছে। শাসন-পরিচালনা যে স্লোগানসর্বস্বতা নয়, নিছক জনতোষণও নয়, বরং কীসে জনসাধারণের বৃহত্তর ও দীর্ঘস্থায়ী মঙ্গল হইতে পারে, তাহার অন্বেষণ ও প্রয়োগ, এই সত্যটি সম্ভবত ধীরে-ধীরে শাসক গোষ্ঠীর নিকট প্রতিভাত হইতেছে।
শাসনপ্রণালীর সর্ব ব্যাপারে যে তেমনটা ঘটিতেছে, তাহা অবশ্য বলা চলিবে না। যেমন কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রশ্ন। যেমন বাস-ট্যাক্সির ভাড়া-বৃদ্ধির প্রশ্ন। শিল্পায়নের জন্য, বাঁধ, জলাধার, বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ কিংবা রেলপথ ও জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের মতো জনকল্যাণকর পরিকাঠামোগত কাজের জন্য কৃষিজমি ছাড়া অন্য কোনও জমি যে রাজ্যে নাই, এই সত্যটি মানিয়া লইতে যে যুক্তিবুদ্ধি দরকার, অধিগ্রহণের পক্ষে সওয়াল করার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। অথচ এই ক্ষেত্রে সরকার অনমনীয় মনোভাব লওয়ায় রাজ্য অর্থনীতির ক্ষতি হইতেছে। একই ভাবে জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাস-ট্যাক্সির মতো পরিবহণের খরচ যে বাড়িয়া গিয়াছে, যাহা তুলিতে হইলে ভাড়াবৃদ্ধি অপরিহার্য, এই সরল সত্যটুকু সরকারি তথা দলীয় নেতৃত্ব মানিতে নারাজ। জনসাধারণের উপর বোঝা না বাড়াইবার কুযুক্তি দিয়া তাঁহারা কার্যত রাস্তা হইতে পরিবহণ ব্যবস্থাটাই তুলিয়া দিবার জোগাড় করিতেছেন। দেশি মদের ‘টেট্রা-প্যাক’ চালু করার সিদ্ধান্তে যে বাস্তববাদিতা, যথার্থ জনকল্যাণের স্বার্থেই বৃহত্তর পরিসরেও তাহার প্রয়োগ জরুরি। |