আয়তন দিয়া যে গুরুত্বের পরিমাপ হয় না, ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী মলদ্বীপই তাহার প্রমাণ। আকার যেমনই হউক, এই দ্বীপপুঞ্জ-দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী ও কেমন, ভারতের পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলের কূটনৈতিক ক্ষমতা-বিন্যাসের ক্ষেত্রে তাহার গুরুত্ব আছে। যে কোনও ভাবেই এই দ্বীপদেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা তাই কেবল মলদ্বীপের নিজের জন্য নহে, ভারতের দৃষ্টিকোণ হইতেও অতীব জরুরি। অথচ সে সম্ভাবনা যেন ক্রমশই ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতে শুরু করিলে মাঝপথেই বাধা পড়ে। স্বয়ং সরকারি প্রশাসনই সেই বাধার রচয়িতা। নির্বাচন বাতিল করিতে পুলিশকে কাজে লাগানো হয়। নির্বাচন কমিশনার ফুয়াদ তৌফিকের দফতরে হানা দিয়া পুলিশ ব্যালটপত্র বিতরণ বন্ধ করিয়া দেয়, ভোটগ্রহণ মুলতুবি হয়। অবশ্য ইতিপূর্বেও মলদ্বীপের গণতন্ত্র-পথে অবরোধ ঘটিতে দেখা গিয়াছে। মাউমুন গাইয়ুম-এর দীর্ঘ তিন দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাইয়া দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে (২০০৮) যে মহম্মদ নাসিদ প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হইয়াছিলেন, তাঁহাকে ২০১২ সালে পদত্যাগে বাধ্য করেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মহম্মদ ওয়াহিদ, যিনি নিজেই প্রেসিডেন্ট হইয়া বসেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ধার্য ছিল গত সেপ্টেম্বরে। সেই নির্বাচনে কোনও প্রার্থীই পঞ্চাশ শতাংশ ভোট না-পাওয়ায় পুনরায় ভোটগ্রহণ ধার্য হয় অক্টোবর মাসে। অতঃপর সেই নির্বাচনের মহাক্ষণেই সশস্ত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশবাহিনী, আরও স্পষ্ট করিয়া বলিলে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদের পুলিশবাহিনী। আরও স্পষ্ট করিলে, ৪৫ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাসিদের পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকাইতেই বর্তমান প্রশাসনের এই কুনাট্যরঙ্গ।
নাসিদের অপরাধ সম্ভবত ইহাই যে, তিনি দ্বীপপুঞ্জে ভারতবন্ধু বলিয়া গণ্য। ভারত যে এই দ্বীপপুঞ্জে গণতন্ত্রের প্রসার দেখিতে চায়, তাহা নয়াদিল্লি কখনও গোপন করে নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনও এ ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগী। কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জ বিষয়ে চিনও কম উৎসুক নয়। ভারতবন্ধু মহম্মদ নাসিদ সম্ভবত সে ব্যাপারে চিনকে সহায়তা দিতে আগ্রহী নন। এই কারণেই কি এত সুসংগঠিত প্রতিরোধ? যে ভাবে মহম্মদ নাসিদকে প্রায় ফৌজি অভ্যুত্থানের কায়দায় ক্ষমতাচ্যুত করা হয় কিংবা পুলিশ দিয়া নির্বাচন বানচাল করা হয়, তাহাতে স্পষ্ট, নাসিদ-বিরোধীরা আটঘাঁট বাঁধিয়া আসরে অবতীর্ণ। চিন তাহার রকমারি উপঢৌকনের পসরা লইয়া এই দ্বীপরাষ্ট্রের জনসাধারণ ও রাজনীতিকদের পক্ষে টানার চেষ্টায় রহিয়াছে। তুলনায় নয়াদিল্লি কতকটা পিছাইয়া। সুতরাং ভারতের প্রভাব-বলয়ের অধীন হওয়া সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার মতোই মলদ্বীপও নয়াদিল্লির আর নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়। ফলত, ভারতের বিদেশসচিব সুজাতা সিংহের সতর্ক সাবধানবাণী, ‘মলদ্বীপের সমস্যা ভারতেরও সমস্যা’।
তবে গণতন্ত্রের যুক্তিতেই কোনও বহিঃশক্তির পক্ষে মলদ্বীপের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ লইয়া প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য। মলদ্বীপে আজ যে সব ব্যক্তি বা স্বার্থচক্র জনপ্রিয় রাজনীতিক মহম্মদ নাসিদকে ক্ষমতা হইতে দূরে সরাইয়া রাখার চক্রান্তে লিপ্ত, তাঁহারা নিশ্চয় খেয়াল করিতেছেন, যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মহম্মদ ওয়াহিদ একদা নাসিদকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়াছিলেন, তিনি মোটেও ভোটাধিক্যে গগন কাঁপাইয়া ফিরিয়া আসিতেছেন না। ইহাই আশার কথা। সংবিধান অনুযায়ী ১১ নভেম্বরের আগেই নূতন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাধ্যতামূলক। সেই লক্ষ্যে নভেম্বরের গোড়ায় আবারও নির্বাচনের নূতন দিনক্ষণ ধার্য হইয়াছে। এই পর্বের ভোটে যাহাতে গণতান্ত্রিকতা বজায় থাকে, তাহা নিশ্চিত করা জরুরি। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। |